নবান্ন উৎসবের মাতালো গ্রামীণ জনগোষ্ঠী

নবান্ন উৎসবের মাতালো গ্রামীণ জনগোষ্ঠী

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী

বাংলার অগ্রহায়ণ মাস মানেই বাঙালি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীদের জন্য, বিশেষ করে কৃষক-কৃষাণীদের জন্য বিশেষ একটি মাস। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার চারিদিকে শুধু মাঠ ভরা পাকা ধানের সমাহার। বাঙালির ঘরে ঘরে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে অন্য একটি আবেশ বিরাজ করে। এ মাসটিতে সকল কৃষক-কৃষণীদের মুখে অনাবিল আনন্দের হাসি ফুটে উঠে। বাঙালি জাতির নিকট এ মাসটি যেন একটি উৎসবের মাস এবং খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। অগ্রহায়ণ মাস যেন কৃষকদের স্বপ্নের একটি মাস। এমাসেই গ্রামের কৃষক সমাজ আগামী দিনের জন্য স্বপ্নের বীজ বপন করে। ছয় মাসের খোরাক মজুত করাব পর উদ্বৃত্ত¡ ধান বিক্রি করে তা দিয়ে তারা সংসারের যাবতীয় কাজ কর্ম করেন। অগ্রহায়ণ মাস বাংলার ধনী-গরীব সকলের মুখে হাসি ফোটায়। অগ্রহায়ণ মাস শেষ হতেই দেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে নতুন ধানের ভাপা পিঠা, চিতই ও মেরা পিঠা সাজিয়ে বসে দরিদ্র পরিবারের গ্রামীণ নারী-পুরুষ, যা, আমাদের মনে করিয়া দেয় বাঙালি ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবকে।

নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বড় কাইলাটি গ্রামের কিশোরীদের একটি সংগঠন ‘শিকড় কিশোরী সংগঠন’। শিকড় কিশোরী সংগঠন ও গ্রামের কৃষাণীদের উদ্যোগে গতকাল অনুষ্ঠিত হলো বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব। গ্রামের নবীন, প্রবীণ, যুব, শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা তাদের তৈরি করা বাহারী পিঠা নিয়ে এই নবান্ন উৎসবে অংশগ্রহণ করে। বাহারী পিঠা প্রদর্শনীর পাশাপাশি নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভা ও গ্রামীণ খেলাধূলার।

IMG_20191114_130708-W600
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ইউনিয়ন বৈচিত্র্য সুরক্ষা কমিটির সদস্য জেসমিন আক্তার বলেন,‘অগ্রহায়ণ মাস মানেই বাঙালির নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণে বাংলার গ্রামের চারিদিকে ধানা কাঠার মহাধুম পড়ে যায়। ঘরে ঘরে বাঙালি রমনীরা নতুন ধানের বাহারী পিঠা তৈরী করে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের নিয়ে আনন্দ করে খায়। শত কষ্টেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এ উৎসবে পরস্পরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগী করে নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু যান্ত্রিকতার এ যুগে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে দিন দিন হারিয়ে যাতে বসেছে আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতি। তাই আমরা কিশোরীরা গ্রামীণ এই সংস্কৃতি চর্চা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট জাগিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আজকের এ আয়োজন আমাদের জন্য, গ্রামের সকলের জন্য ঐতিহ্যের।’

IMG_20191114_130745-W600
গ্রামের প্রবীণ নারী হাজেরা বেগম পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন,‘আগে আমরা অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার পর থাইক্যা আরম্ভ কইরা গেরামের বেইটতানেরা মিল্লা ধান সিদ্ধ কইরা রইদে শুকাইয়া ধান ভাইননা চাইল কুইটটা হেই গুড়াডা দিয়া হারা রাইত ধইরা পিঠা মেলা রহমের পিঠা বানাইত। সারা রাইত আমরা হগগলে মিইললা সুখ-দুঃখের গপ্প গুজব কইরা পিঠা খাইতাম। হগগলে আমরা সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি কইরা নিতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘এহন গেরামের মাইয়া ও শহরের মাইয়াগোর মধ্যে মেলা ফারক, হগগলে যার যার কাম নিয়া ব্যস্ত। এখন আগের মতন মাইনষের মুহে হাসি নাই, আনন্দ নাই, সবাই নিজেরে নিয়া ব্যস্ত। বারসিক আমারার পোলা-পাইনগো নবান্ন উৎসব করার জন্য সহযোগিতা করেছে। নবান্ন উৎসব আমারে পুরানো দিনের স্মৃতি মনে করাইয়া দিল। আইজ মেলা দিন বাদে হগগলে মিইললা পিঠা বানাইয়া আবার হগগলে মিইললা আমুদ কইরা পিঠা খাইলাম, খুব তৃপ্তি পাইলাম। বেজাই ভালা লাগছে।’

IMG_20191114_132854-W600
স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (মেম্বার) নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে আমরা অনেক জাতের মজার মজার ধান চাষ করতাম, কিন্তু এখন আর আমরা সেই সব জাতের ধান চাষ করি না। আমরা সবার সাথে তাল মিলিয়ে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করি, এসব ধানে মৌ মৌ গন্ধ নেই। তবুও অগ্রহায়ণ এলেই মাঠের পাকা ধানের সোনালি রং আমাদের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। নবান্ন মানেই বাংলার গ্রামে গ্রামে নতুন ধানের পিঠা, পায়েস খাওয়ার ধুম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এ গ্রামীণ সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। বাঙালির এ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে নতুন প্রজন্মকে এগুলোর সাথে যুক্ত করতে হবে। এই অনুষ্ঠানের ফলে বহু বছর পর আজ আমি পুরনো খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমার গ্রামের মা চাচীরা সবাই এক সাথে আনন্দ উপভোগ করতে পারলো।’

IMG_20191114_135933-W600
নবান্ন উৎসব উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে কাইলাটি গ্রামের সকল বয়সের নারী-পুরুষের জন্য বৈচিত্র্যময় গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ খেলাধুলা শেষে কিশোর-কিশোরী ও যুবরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকলকে মুগ্ধ করে রাখে। শেষে গ্রামীণ খেলাধুলায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করেন গ্রামের প্রবীণ নারীরা।

happy wheels 2

Comments