নেত্রকোণায় কৃষক নেতৃত্বে ধানের জাত গবেষণা কার্যক্রমের কৃষক মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত
নেত্রকোণা থেকে রুখসানা রুমী
বর্তমান আধুনিক কৃষি মূলত রাসায়নিক উপকরণ নির্ভর কৃষি। ফসল চাষের সকল ক্ষেত্রেই বর্তমান সময়ে রাসায়নিক সার, বাহারী নামধারী কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহার করা হয়। কৃষি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষি বিজ্ঞানীগণ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাত আবিষ্কার করে কৃষকদের নিকট সম্প্রসারণ করছেন। নতুন নতুন ফসলের জাত আবিষ্কারের পাশাপাশি হরেক রকমের নতুন নতুন রোগ-বালাই ফসলের ক্ষেতে আক্রমণ করে ফসলের ক্ষতি সাধন করে। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এসব উন্নত জাতগুলো দেশের সকল ধরণের মাটি ও আবহাওয়া জন্য সমান উপযোগি না হওয়ায় কৃষকরা অশানুরূপভাবে লাভবান হতে পারছেনা। তাই কৃষকেদের চাহিদা এলাকা উপযোগী ফসলের জাত যা’ তাদের জমির মাটি ও এলাকা উপযোগি, রোগ-বালাই সহনশীল ও ফলন হবে আশানুরূপ।
নেত্রকোনা অঞ্চলের কৃষকরা বারসিক’র মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিগত ২০০৫ সাল থেকে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনের জন্য প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কৃষক নেতৃত্বে প্রায়োগিক গবেষণার ধারাবাহিকতায় নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের আশুজিয়া গ্রামে কৃষকরা ২০১৬ সাল থেকে ধানের জাত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আশুজিয়া গ্রামের কৃষক আবুল কালাম এর নেতৃত্বে কৃষকদের উদ্যোগে আমন ২০১৮ মৌসুমে ৮টি স্থানীয় ধানের জাত নিয়ে প্রায়োগিক কৃষি গবেষণা স্থাপন করা হয়েছে। আগাম ও ফলন বেশি এবং রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ কম হয় এমন ধানের জাত বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে গ্রামের কৃষকরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছে।
ধান আগাম হলে আমন ধান কাটার পর বোরো ধান চাষ করার মাঝের সময়ে স্বল্প সময়ে হয় এমন রবি ফসল ফলানো যায়। প্লটের অধিকাংশ ধান পেকে যাওয়ায় সংগঠনের সদস্যরা একটি কৃষক মাঠ দিবসের আয়োজন করে। মাঠ দিবস উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এক আলোচনা সভা এবং সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন ও ধানের জাতসমূহ পর্যবেক্ষণ করে পছন্দের জাত বাছাই করা। মাঠ দিবসের আলোচনায় গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কৃষকরা গবেষণার উদ্দেশ্য, গবেষণা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে উপস্থিত সকলকে বিস্তারিত জানান। আলোচনা শেষে গবেষক টীমের অন্যতম সদস্য কৃষক আবুল কালাম অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে গবেষণা প্লট পরিদর্শন করে, ধানের গোছায় চারার সংখ্যা, গাছের উচ্চতা, শীষের দৈর্ঘ্য, প্রতি শীষে দানা ও চিটার সংখ্যা, দানার আকৃতি, রোগ-বালাইয়ের আক্রমণের অবস্থা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তিতে কৃষকরা তাদের পছন্দের ধানের জাত নির্বাচন করেন। কৃষকরা নিজ নিজ পছন্দের ধানের জাতগুলো কেটে মাড়াই করে প্রাপ্ত ফলাফল পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন।
মাঠ দিবসে কৃষকরা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে চারটি ধানের জাত নির্বাচন করেছেন। কৃষকদের নির্বাচিত ধানের জাত ও নির্বাচনের বৈশিষ্ট্যগুলো হল- ঋতু পাইজা (শীষ লম্বা, শীষের গাথুনী বেশি ও পুষ্ট দানার সংখ্যা বেশি), সোনালী পাইজাম (শীষে দানার সংখ্যা ও ফলন বেশি), মালশিরা (শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা বেশি ও পোকার আক্রমণ কম) এবং সাদা চিকন (শীষ লম্বা, দানা চিকন, বাজার মূল্য বেশি, পোকার আক্রমণ কম)।
কৃষকদের পছন্দকৃত চারটি ধানের জাতের মধ্যে মালশিরা ধানটি বেশি সংখ্যক কৃষক পছন্দ করেছেন। এর অন্যতম কারণ হলো এই ধানের শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা বেশি, শীষ লম্বা, গাছ মাঝারী লম্বা, ফলে হেলে পড়েনা, রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়নি এবং ধানের আকার চিকন। অনেক কৃষকের মতে, এ ধানের ভাত খেতেও সুস্বাদু।
কৃষক নেতৃত্বে এলাকা উপযোগি ধানের জাত বাছাইয়ে প্রায়োগিক গবেষণার ফলে আশুজিয়া গ্রামের কৃষকদের ধানের জাত গবেষণা বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণার ফলাফল কৃষক মাঠ দিবসের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী কৃষক-কৃষাণীদের সাথে সহভাগিতার ফলে গবেষণার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে সকলে জানতে পেরেছে। অংশগ্রহণকারী কৃষকরা গবেষণার ফলে এলাকা উপযোগি এবং পছন্দের ৪টি স্থানীয় জাতের ধান নির্বাচন করতে পেরেছেন। তারা কৃষক সংগঠনের নিকট নির্বাচিত ধানের বীজের চাহিদা দিয়েছেন আগামী আমন মৌসুমে চাষের জন্য। ফলে এলাকায় আগামী মৌসুমে আরও চারটি স্থানীয় ধানের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।