স্থানীয় জাতের সীম চাষি জাহানারা আক্তার

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
নেত্রকোনা সদর উপজেলা মদনপুর ইউনিয়নের সবুজ ছায়াঘেরা, শস্যে ভরা সুনিবিড় একটি গ্রাম মনাং। এ গ্রামেরই একজন কৃষাণী জাহানারা আক্তার (৪৫)। একই গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর সবুজ মিয়ার সাথে বিয়ে হয় জাহানারা আক্তারের, কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি স্বামীকে বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি মনাং গ্রামে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। দুই ছেলে, দ্ইু মেয়ে সন্তান ও স্বামীসহ মোট ছয় জনের সংসার তার। বাবার সংসারে সম্পদ বলতে ছিল শুধু বসতভিটাসহ মাত্র ৩০শতাংশ জমি। স্বামী সবুজ মিয়া খেটে খাওয়া একজন দরিদ্র কৃষক। বিয়ের পর স্বামীর সামান্য রোজগারে কোন রকমে তাদের সংসার চলত। জাহনারা আক্তার ছোট বেলায় মাকে দেখে বসতবাড়ীতে সবজি চাষ, হাসঁ-মুরগি ও গবাদি পশু পালন এবং বসতভিটার সামান্য জমিতে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করে সংসারের ব্যয় নির্বাহের কৌশল সম্পর্কে ধারণা পান।

স্বামীর সংসারে আসার পর থেকে তিনিও বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করে এবং বাড়ির চারপাশে স্থানীয় বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করতে থাকেন। সেই উৎপাদিত সবজি, ডিম ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করে যে আয় হয় তা দিয়ে তিনি ভালোভাবেই সংসার চালাতে সক্ষম হন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে লেখাপড়া শেষ করেছে। বড় ছেলে ও এক মেয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ছোট ছেলে এক কোম্পানিতে চাকুরী করেন এবং ছোট মেয়েটি এখনও পড়াশুনা করছে। শুধুমাত্র কৃষি কাজের আয় দিয়েই তিনি চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছেন।

Jahanara Akter 2
জাহানারা আক্তার একজন সাধারণ গ্রামীণ নারী হলেও অন্য নারীদের তুলনায় তিনি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। তার উন্নতির মূল পূঁজি হল কঠোর পরিশ্রম ও কৃষি কাজের দক্ষতা। তিনি বাড়ির চারপাশের সামান্য জমি কাজে লাগিয়ে অর্থ উর্পাজন করছেন এবং প্রয়োজনীয় সবজি বীজ নিজেই সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে যেমন বিষমুক্ত নিরাপদ খাদ্য খাইয়ে থাকেন, তেমনি ভোক্তাদের জন্যও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করেন। জাহানারা আক্তার গ্রামের অন্যান্য কৃষাকদের থেকে ভিন্ন উপায়ে অতি যত্নে সবজি বীজ রোপণ ও সবজির পরিচর্যা করে থাকেন। কোন সবজি কোন জায়গায় ভালো হবে, কখন রোপণ করতে হবে, কোনটাতে পোকা লেগেছে, কোন গাছের এখন কি লাগবে এসব বিষয় তিনি নিজ অভিজ্ঞতা থেকে নির্ধারণ করেন। সবজি বাগানের যত্ন নেয়া, ফসল সংগ্রহ, সবজি বিক্রি, সবজি ও সবজি বীজ সংরক্ষণ এবং হাঁস-মুরগির ব্যবস্থাপনা করেই ব্যস্ত সময় কাটে জাহানারার। তিনি নিজ উদ্যোগে বাড়ির পাশে ও পুকুর পাড়ের সামান্য জমিতে আট জাতের সীমের চাষ করেছেন। সীমের জাতগুলো হল- গুতুম সীম, চিকড়া সীম, পুটিঁ সীম, খৈলসা সীম, সুন্দরী, আশ্বিনা সীম, কাইক্যা সীম, কার্তিক সীম।

সবজি চাষে তিনি জমিতে গোবর, তরিতরকারির উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে তৈরি কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করে থাকেন। গতবছর তিনি নিজে পাঁচ জাতের শিম বীজ সংরক্ষণ করেছিলেন এবং গ্রামের অন্য কৃষাণীদের থেকে আরও তিন জাতের শিম বীজ সংগ্রহ করে পুকুরের পাড়ে এ মৌসুমে রোপণ করেছেন। এছাড়াও তিনি নিজ গ্রাম ও অন্য গ্রামের কৃষাণীদের সাথে নিজের সংরক্ষিত পাঁচ জাতের শিম ও বৈচিত্র্যময় সবজি বীজ বিতরণ ও বিনিময় করেছেন।
এ বিষয়ে জাহানরা আক্তার বলেন, ‘বাজারে আশ্বিনা শিমের দাম অন্যান্য শিমের চেয়ে বেশি। ভরা মৌসুমেও এই জাতের শিম ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। আশ্বিনা জাতের প্রায় ২০০ কেজি শিম তিনি বিক্রি করেছেন। চারটি মাদায় আশ্বিনা শিম রোপণ করেছিলেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে তিনি প্রায় চার হাজার টাকা আয় করেছেন এবং আগামী মৌসুমের জন্য বীজ সংগ্রহ করে রেখেছেন। আশ্বিনা শিম তরকারী, ভর্তা ও ভাজির সবভাবে খাওয়ার জন্য খুবই উপযোগি।

কাইক্যা শিম নেত্রকোণা অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয়। এই শিম ফৈইলা মাছ ও কৈ মাছ দিয়ে রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয়। পরিবারে চাহিদা মিটিয়ে, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের বিতরণ করে তিনি প্রতি কেজি কাইক্যা শিম ২০ টাকা দরে প্রায় ১২০ কেজি সীম প্রায় দুই হাজার চারশত বিক্রি করেছেন।  বাজারে খৈইলা শিমের চাহিদা অনেক। নেত্রকোনা অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিকট শুটকী মাছ খুবই প্রিয়, খৈলসা শিম শুটকী মাছ দিয়ে রান্না করলে খুবই সুস্বাদু হয় বিধায় এ শিমটি এ অঞ্চলে খুব জনপ্রিয়। এ জাতের শিম প্রতি কেজি ২০ টাকা (গড়ে) দরে তিনি প্রায় দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।

কার্তিক শিম কার্তিক মাস থেকে সংগ্রহ করা যায়। বাজারের এই শিমের চাহিদাও অনেক। চলতি মৌসুমে শীত কম হওয়ায় পোকার আক্রমণ বেশি ছিল এবং ফলন কম হয়েছে। পুটি শিমের সাথে শুটকী মাছের তরকারি এবং শিম বীজ দিয়ে ডাল রান্না খুবই সুস্বাদু হয়। নেত্রকোণা অঞ্চলের সর্বত্র এই শিমের কদর বেশি।

শিম চাষে কোন রকম খরচ ছাড়াই (শুধুমাত্র বাঁশের আগা পুঁতে দেয়া) জাহানারা আক্তার চলতি মৌসুমে প্রায় পনের হাজার টাকা শিম বিক্রি করেছেন। জাহানারা আক্তারের মতে, কারো অল্প জমি থাকলেও ঠিকমত স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ ও সঠিক ব্যবস্থাপনা করে সহজেই পরিবারের অর্থনৈতিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। তিনি সবজি চাষে সাধারণত কোন ধরনের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন না। সবজির জমিতে কোন রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ হলে তিনি নিজে জৈব বালাইনাশক তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে কুয়াশা ভেজা শিম গাছে বাসি ছাই ছিটিয়ে দিয়ে জাব পোকা দমন করেন।

Jahanara Akter
তিনি গত বছর নিজের চাষকৃত পাঁচটি স্থানীয় জাতের শিম বীজ সংরক্ষণ করে এ মৌসুমে নিজে চাষ করেছেন এবং নিজ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী ২০টি গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জাহানারা আক্তার বলেন, ‘আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যে, আমি সকল ফসলের বীজ নিজেই সংরক্ষণ করবো, অন্যদেরকেও বীজ দিয়ে সহযোগিতা করে তাদেরকে বীজ সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়ে যাব। আমি সবসময় অন্য নারীদেরকে জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার পরামর্শ দেই। আমার আরেকটি লক্ষ্য ছোট মেয়েকেও লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলা।’

কৃষাণী জাহানারা আক্তার শুধু সবজি চাষিই নয়, তিনি একাধারে একজন গবাদি পশু-পাখি পালক এবং বৈচিত্র্যময় সবজির বীজ সংগ্রাহক, সংরক্ষণকারী ও জৈব কৃষি চর্চাকারী। জাহানারা আক্তারের ন্যায় গ্রামের সকল কৃষক-কৃষাণীরা যদি জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করে এবং নিজেদের উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করে, তাহলে সকল ভোক্তাদের জন্য যেমন নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত হবে, তেমনি বীজের জন্য কৃষকদের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। কৃষক-কৃষক পারস্পারিক বীজ ও কৃষি উপকরণ বিনিময় বৃদ্ধি পেলে এবং পরস্পারিক সহযোগিতা ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকরা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধানে সক্ষম হবে।

happy wheels 2

Comments