সকল কন্যাশিশুই বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক

ঢাকা থেকে সুদিপ্তা কর্মকার
১৪ বছর বয়সী রিনা আক্তার অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। পড়াশানায় ভালো, বড় হয়ে শিক্ষক হবার ইচ্ছা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রিনার বাবার করোনার সময় গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাবার কারণে তাঁর চাকরি চলে যায় এবং শহরে বাসা ভাড়াসহ পরিবার চালানো কষ্টের কারণে পুরো পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যান। গ্রামে রিনার বিয়ে ঠিক হয়। রিনা জানায়, ‘আমি বিয়ে করতে রাজি নই, আমি পুলিশকে ফোন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার আত্মীয়সজন আমাকে আমার বাবার আর্থিক অবস্থা এবং আমার পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে এই কথা বলে আমাকে মানসিকভাবে দূর্বল করে তোলে। আমার সব স্বপ্ন সেদিনই শেষ হয়ে যায়।’ কাদেরাবাদ হাউজিং এর বোটঘাট বস্তির রিনা আক্তারের মত গত বছর করোনার সময় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে আরও অনেক কন্যা শিশু। গত ৮ই মার্চ বিশ^ নারী দিবসে বারসিক কর্তৃক কোয়ালিশন ফর দি আরবান পুয়র (কাপ) মিলনায়তনে কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের বোটঘাট বস্তির ১৬ জন সদস্য নিয়ে ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে নগরের বাল্যবিয়ের উপর প্রভাব’ বিষয়ক আয়োজিত একটি কর্মশালায় রিনা আক্তার উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন। উক্ত কর্মশালায় বারসিক’র কর্মসূচি কর্মকর্তা সুদিপ্তা কর্মকার, প্রজেক্ট ম্যানেজার ফেরদৌস আহমেদ, কমিউনিটি মবিলাইজার সাবিনা নাঈম এবং কামরুন্নাহারসহ মোট ২২জন উপস্থিত ছিলেন। করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মশালাটির আয়োজন করা হয়।

২০১৯-২০ সালে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে অনেক বেড়ে যায়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৯ সাল এর থেকে ২০২০ সালে বাল্যবিয়ে ৪৪% বেড়ে গেছে এবং তার জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে বিশ^ব্যাপী করোনা মহামারীকে ধরা হয়। করোনা মহামারীর সময় চাকুরীহারা হয় অনেক মানুষ। যার মধ্যে নি¤œআয়ের মানুষ বেশি যারা অধিকাংশই গার্মেন্টস, গৃহকর্মী এবং যাতায়াত সেক্টরে কাজ করেন এবং এই সেক্টরগুলো করোনার সময় বেশিরভাগই বন্ধ হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, পরিবারগুলো আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হওয়ার কারণে পরিবার এর কন্যাশিশুটিকে বিয়ে দেবার মাধ্যমে দায়িত্ব কমানোর চিন্তা করেন পরিবারের কর্তা। এছাড়াও কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দারিদ্রতা, কাজ হারিয়ে হতাশাগ্রস্ত হওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, পরিবারে শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাব, তথাকথিত ভালো পাত্র হাতছাড়া না করা, ইভটিজিং এবং টিকটক, মেয়েদের পর্দানশীলভাবে চলাচল না করা, প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করা, বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে এই ধারণা, পারিবারিক সম্মান রক্ষা করা ইত্যাদি কারণগুলোকে দায়ী করেন।


এই সকল কারণের জন্য বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকেরা তাদের কন্যাসন্তানের বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এই ধারণায় বিশ^াস করেন। অপ্রাপ্ত বয়সে কন্যাসন্তানের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে তারা জীবনের শুরুতেই নানা সমস্যার মধ্যে পরে। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের কাছে বাল্যবিয়ের কুফল এবং প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, বাল্যবিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, মেয়েটির শারীরিক অপুষ্টি এবং মানসিক নানা সমস্যার মধ্যে পরে, অপ্রাপ্ত বয়সে সন্তান জন্মদানের সময় মা ও শিশুর নানা সমস্যা তৈরি হয় এবং উভয়ের মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে, অপুষ্টির কারণে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়, বয়স কম থাকার কারণে পারিবারিক বোধ তৈরি হয় না, বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারিবারিব নির্যাতন এর শিকার হয়, বহুি য়ে বেড়ে যাচ্ছে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে কখনো কখনো মেয়েটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।


এমজেএফ এর তথ্যসূত্র মতে, ২০১৯ সালে যেখানে ৭০টি বিয়ে হয়েছিল সেখানে ২০২০ সালে বেড়ে গিয়ে ১০১টি বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়। ঢাকা ট্রিবিউন এর তথ্য মতে, ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি হটলাইন ৯৯৯ বাল্যবিয়ে রোধে ২০১৯ সাল এর তুলনায় ২০২০ সালে ৪৫% বেশি কল পায়। অভিভাবকেরা টাকার বিনিময়ে তার কন্যাসন্তানের বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিচ্ছে সেক্ষেত্রে আইনানুগ কোন ব্যবস্থাও নেয়া যায় না, কোন কোন সময় বাল্যবিয়ে বন্ধ করলে রাতের অন্ধকারে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়ে মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। আর এই পরিসখ্যানই বলে দিচ্ছে বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজে কিভাবে তার শিকড় বৃদ্ধি করছে। বাল্যবিয়ে শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত ক্ষতি নয় এটি পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতি। একটি জাতিকে সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে হলে সমাজে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে তাদের কন্যাসন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য। একজন শিক্ষিত মা একটি শিক্ষিত জাতি তৈরি করার প্রথম কারিগর। ছেলে এবং মেয়েদের সমান অধিকার এই শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হবে, তাহলে পরিবার এবং সমাজে মেয়েরা বঞ্চিত কম হবে। বাবা মাকে সব সময় সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাহলে সন্তানও যেকোন ভূল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকবে। সর্বোপরি যেখানেই বাল্যবিয়ে হবে সেখানেই আইন এর আশ্রয় নিতে হবে, ৯৯৯ এ ফোন করে পুলিশ এর সাহায্য নিতে হবে।


বাল্যবিয়ে রোধে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি এলাকায় একটি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলতে হবে। আমাদেে সচেতনতাই একটি মেয়ের জীবন সুন্দর করে তুলতে পারে। বিশ^ নারী দিবসে আমাদের সকলের এই অঙ্গীকার হোক সকল কন্যাশিশুই বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত হোক।

happy wheels 2