বট ও পাকুর গাছের একাত্মতা
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
শিশু সাহিত্যের নান্দনিক কবি, গ্রামীণ দৃশ্যাবলীর ভাষ্যকার, ময়নামতির চর’র কবি বলে আখ্যায়িত বন্দে আলী মিয়া তার “ময়নামতীর চর” কবিতায় চরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “এই চরে ওই হালটার কোনে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি/ বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি। গায়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া/ ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বিয়া।”
ঠিক তেমনি আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর পূর্বে পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের চিনাভাতকুর গ্রামে বট ও পাকুর গাছের বিয়ে দিয়েছিলেন উক্ত গ্রামের স্বর্গীয় সতীশ চন্দ্র হালদারের নিঃসন্তান স্ত্রী স্বগীয় শ্রীমতি খুকী বালা হালদার। হিন্দু বিবাহ রীতি অনুসরণ করে সে সময় জাকজমকভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বট পাকুরের সেই বিয়ের গল্প আজো এ এলাকার মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। বিঘে দুই না হলেও তার কাছাকাছি জায়গা জুড়ে থাকা এ বট পাকুড় গাছ দুটি আজো মাথা উঁচু করে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থেকে গ্রামের সমাজের এমনকি রাষ্ট্রের মানুষকে যেন মিলেমিশে থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সরেজমিন ২৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার দুপুরে পাবনার চাটমোহর পৌরসদর থেকে চাটমোহর-হান্ডিয়াল সড়ক ধরে ৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এ গ্রামটিতে গেলে গ্রামের প্রবীণ মানুষদের নিকট থেকে শোনা যায় এ যুগল বট পাকুরের পৌরাণিক গল্প। চিনাভাতকুর উত্তর পাড়ার প্রবীণ ব্যক্তিত্ব আলহাজ¦ জাবেদ আলী বলেন, “এ গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস সুদীর্ঘকাল থেকে। আমরা শুনেছি উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে চিনাভাতকুর গ্রামের সতীশ চন্দ্র হালদারের স্ত্রী শ্রীমতি খুকী বালা পাশাপাশি এ বট ও পাকুর গাছ দুটি লাগিয়েছিলেন। তিনি নিঃসন্তান থাকায় পরম মমতায় গাছ দুটির যত্ন করতেন। গাছ দুটিকে তিনি ছেলে মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। গাছ দুটি যখন যৌবনে পদার্পণ করে এমন সময়, এখন থেকে প্রায় ৭০ বছর পূর্বে হিন্দু রীতি অনুযায়ী তিনি গাছ দুটির বিয়ে দেন। এ উপলক্ষে এলাকার মানুষকে নিমন্ত্রণ করেও খাওয়ান।”
মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু হালদার, মালাকার, কায়স্থ ও ঘোষ সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এ গ্রামে। পুজো পার্বণ ও ঈদের আনন্দ যেন ভাগাভাগি করে নেন তারা। এ গ্রামের অপর প্রবীণ ব্যক্তি চৈতন্য হালদার ভাষা বলেন, “আমরা ছোট বেলা থেকে গাছ দুটিকে এভাবে জড়াজড়ি করে থাকতে দেখে আসছি। শুনেছি শ্রীমতি খুকী বালা গাছটির নাম রেখেছিলেন বিশ্বনাথ। পাশেই রয়েছে হরি মন্দির, তাই অনেকে এ জায়গাটিকে হরি বটতলা বলেও ডাকেন।”
সতীশ চন্দ্র হালদারের ভাইয়ের ছেলে জীবন হালদার বলেন, “আমার জেঠা ও জেঠীর ছেলে মেয়ে ছিল না। তিনি গাছ দুটোকে তার ছেলে মেয়ের মতো ভাবতেন। ডাল কাটা তো দুরের কথা কাউকে গাছের পাতা পর্যন্ত ছিড়তে দিতেন না। জেঠা জেঠী তাদের মৃত্যুর পূর্বে গাছ দুটো আমাদের দেখাশুনা করতে বলে গেছেন। গাছের উত্তর পাশে হরি মন্দির রয়েছে। সেখানে পূজা হয়। গাছের নিচে ও বৈশাখ মাসে আমরা পূজা করি। ভক্তদের সেবা দেই।”
বট ও পাকুর গাছের নিচে মাটির তৈরি কুমীর দেখে সে সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলে জীবন বলেন, “আমরা পৌষ সংক্রান্তিতে এখানে বাস্তু পূজা করি এবং পুরুষানুক্রমে উপাসিত দেবতা মনে করে আমরা এ পূজা করে আসছি।”
ময়নামতির চর কবিতার মতোই এ বট ও পাকুর গাছের অদূরে রয়েছে শুকনো গাঙের তট। সে গাঙের কূলে কূলে এখনো বর্ষাকালে দাপিয়ে বেড়ায় খরসূলা মাছ। এ গ্রামের পাশেই নদীতে বিরাট দহ রয়েছে যা ছাওয়াল দহ নামে পরিচিত। বর্ষায় প্রচুর মাছ ধরা পরে এখানে। গাঙে যত দিন জল থাকে তত দিন গাঙচিল, মাছরাঙা এখানে ছো দিয়ে মাছ ধরে ঠোঁটে চেপে ধরে নিস্তেজ করে খায়। শুকনো মৌসুমে নদী তটে মাথা নিচু করে ঘাস খায় গরু। নদীর শুকনো বুক এখন ধান ক্ষেত। এ বট পাকুর গাছে কেবল শালিকই নয় হরেক রকম পাখি ঝগড়া করে প্রতি নিয়ত। গ্রামের পরিশ্রমী মানুষগুলো চৈত্র বৈশাখে তাপদাহ থেকে বাঁচতে ভিড় জমায় এ বট পাকুর গাছতলায়। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে চলা এ বট গাছের চার পাশের অজস্র ঠেস মূল যেন গ্রাছটির প্রাচীনত্বের ছাপ বহন করে। ময়নামতীর চর কবিতার সাথে এ বট পাকুর গাছ এবং এর পারিপাশ্বিকতা যেন একই সূতোয় গাথা। খুকী বালার এ বট পাকুর নিজ নিজ ফল খায় না। পাখ পাখালী এ ফল খেয়ে তোলে তৃপ্তির ঢেকুর। এর ঠেস মূলগুলো যেন আমাদের শিক্ষা দেয় এক হয়ে মিলে মিশে শক্তিশালী হয়ে থাকার।