চেতনার বাতিঘর রিক্সাচালক জয়নাল
নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান
ব্রহ্মপুত্রের চর। পরাণগঞ্জ। চারপাশে খোলা মাঠ। মাঝখানে জারুল, তেতুল,বট, নারকেল, সুপারি, আম, জাম, আর কাঁঠাল গাছের ছায়া শীতল পরিবেশের ভেতর কয়েক ঘর টিনশেডের আধাপাকা স্থাপনার বাড়ি। আশপাশের মানুষের স্রোত এ বাড়ির দিকে। গলায় স্টেথিসস্কোপ ঝুলানো চিকিৎসক লাইনে অপেক্ষমাণ মানুষের রোগের সমস্যায় পরামর্শ দিচ্ছেন। এই হলো জয়নালের মমতাজ হাসপাতাল। টাকাওয়ালা মানুষদের বুঝিয়ে দিয়েছেন তোমরা পার না আমি পারি। ঢাকায় রিকশা চালান তিনি। রোদে পোড়ে। বৃষ্টিতে ভেজে। কনকনে শীতে কাঁপে, দুর্যোগে, হরতালে রিক্সা চালান ষাটোর্ধ এক জয়নাল। তিনি সাদামনের মনের মানুষ ময়মনসিংহের পরানগঞ্জের জয়নাল। জয়নাল আবেদিন। বয়স ৬৩। একজন জয়নাল শুধু রিকশা চালিয়ে নিজ গ্রামে একটি হাসপাতাল করেছেন। গড়েছেন একটি বিদ্যালয়। চালাচ্ছেন মক্তব। ছোট সেই হাসপাতালে ছয়টি শয্যা আছে। আছেন ডাক্তার।
আমাদের জয়নাল স্বশিক্ষিত। প্রাইমারি পাস দিতে পারে নাই। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার পরানগঞ্জ ইউনিয়নের টানহাসাদিয়া গ্রামে জয়নাল আবেদিনের বাড়ি। বাবা মো. আবদুল গনি ছিলেন গরীব কৃষক। আবদুল গনির চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে জয়নাল সবার বড়। অভাব অনটনের সাতকাহনে মোড়া ছিল তাদের জীবন। ৩৩ বছর আগের কথা। একদিন সন্ধ্যায় জয়নালের বাবার বুকে ব্যথা ওঠে। দুর্গম চরে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এক ফার্মেসীতে গেলে কোন ঔষধ না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। রাত জয়নালের বাবা মারা যান। মনে কষ্ট পান তিনি। সেই কষ্ট থেকেই অঙ্গীকার।
একটি হাসপাতাল গড়ার পণ করেন জয়নাল। সেই হাসপাতালে বিনা মূল্যে গরিব মানুষের চিকিৎসা হবে। কোন মানুষ যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। একদিন তিনি স্ত্রী লাল বানু ও দেড় বছরের মেয়ে মমতাজকে নিয়ে ট্রেনে ঢাকায় পৌছে হাঁটতে হাঁটতে চলে যান শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির মাঠে। ওই মাঠে পানির ট্যাংকের নিচে সপরিবারে আশ্রয় নেন জয়নাল।
বিক্রমপুরের মোশাররফ হোসেন। কয়েকটি রিকশা ভাড়া খাটাতেন তিনি। জয়নালের সব জেনে মায়া হয় তাঁর। খাওয়ার জন্য ৫০ টাকা দেন। মোশাররফ এক দিনেই রিকশা চালানো শিখিয়ে একটি রিকশাও দেন জয়নালকে। সঙ্গে কলোনির একটি বাসার বারান্দায় ১৫০ টাকা ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। রিকসা চালান টাকা কামান। তিনি একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে চাইলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে হিসাব খুলতে ধরনা দেন। শেষে সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক সালেহা আক্তার তাঁর আবেগের মূল্য দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় ডিপিএস হিসাব খুলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে জমাতে লাগলেন জয়নাল। একই ব্যাংকের দিলকুশা শাখায়ও একটি হিসাব খুললেন তিনি। সেখানে ডিপিএস করেন ৫০০ টাকার।
‘নিয়মিত টাকা জমাতে গিয়ে জান দিয়ে খাটতে হয়েছে। স্ত্রী লালবানু উদয়ন ক্লিনিকে আয়ার কাজ নেন। তিনি কাজ করতে করতে প্রসূতির সেবা ও আনুষঙ্গিক কাজে পারদর্শি হয়ে উঠেন। ২০ বছর রাজধানীতে কেটে যায় জয়নাল পরিবারের। ২০ বছরে গোপনে জমা হয়েছে জয়নালের রক্তমাংস নিংড়ানো টাকা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। মেয়ে মমতাজের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহে। ছেলে জাহিদ হাসান এইচএসচি পাস করে এখন মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে মোবাইল ফোনসেট মেরামতের দোকান দিয়েছেন।
২০০১ হাসপাতাল গড়ার উদ্যোগ নেন জয়নাল। সব সঞ্চয় এক করে পান এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। তা নিয়ে বুকভারা স্বপ্ন নিয়ে পরান গঞ্জে ফেরেন তিনি। বাড়ির কাছে ৪০ হাজার টাকায় ২৪ শতাংশ জমি কেনেন। তিনি মেয়ে মমতাজের নামে” মমতাজ হাসপাতাল” গড়ার ঘোষণা দিলেন। মানুষ পাগল বলে উড়িয়ে দিলেন।
একদিন চলে গেলাম জয়নালের বাড়ি। একটি টিনের ঘরে জয়নালের স্বপ্নের হাসপাতাল। ডা. বসে সুবিধাবঞ্চিত নারী, শিশু, প্রবীণদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখানে কোন বড় অট্রালিকা নেই। শত শত কর্মচারী নেই। দালাল নেই। আছে জয়নালের স্বপ্ন আর কিছু মানুষের চিকিৎসার ঠিকানা। ঘরটি দুটি কক্ষে বিভক্ত। একটি কক্ষে রোগীদের জন্য ছয়টি শয্যা। অন্য ঘরে একপাশে চিকিৎসক ও রোগীর বসার ব্যবস্থা। অন্য পাশে রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয়। আছে পাঁচটি বেড। জরুরি রোগীর জন্য।
ময়মনসিংহ সদর হাসপাতালের বক্ষব্যাধির চিকিৎসক হেফজুল বারী আসেন মমতাজ হাসপাতালে রোগী দেখতে। ওই দিন রোগী হয় সবচেয়ে বেশি। জয়নাল জানান, বর্তমানে ঢাকায় প্রতিদিন দুই বেলা রিকশা চালিয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পান। সপ্তাহে তিন-চার দিন রিকশা চালিয়ে যা আয় হয় তার সিংহভাহ দিয়ে ওষুধ কিনেন হাসপাতালের জন্য। বাকি টাকায় বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন। দিন দুয়েক বাড়িতে থেকে আবার ছোটেন ঢাকায়। এভাবে চলে এখন জয়নালের দিনকাল।
তাঁর হাসপাতালের কথা জানতে পেরে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহনাজ পারভীন এক হাজার ডলার পাঠান। যার কাছে সেই টাকা পাঠানো হয়েছিল তিনি তাঁর বড় অংশই মেরে দেন। কিছু টাকা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে হাসপাতালের জন্য কিছু আসবাব কেনেন জয়নাল। একটি পুকুর তৈরি করে মাছের চাষ করে তিনি যে টাকা পান তা ঔষধ কিনতে ব্যয় করেন। হাসপাতালের পাশে একটি ছোট দোচালা ঘর। এখানেই বিদ্যালয় ও মক্তব চালু করেছেন জয়নাল। সকালে মক্তবে শিশুরা এসে আরবি শেখে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত চলে প্রথম শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান। বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের একজন ফলিয়ামারীর এসএসসি পাস যুবক মো. আইয়ুব আলী জানান, বিদ্যালয়ে এখন ১২০ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে ৭০ জনের মতো ছাত্রী। তাদের বিনা মূল্যে বই-খাতা দেওয়া হয়। কোনো ফি নেওয়া হয় না। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মুজিবর রহমান ফকির, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, প্রফেসর আবু সায়িদ,লেখক আনিসুল হক তার হাসপাতাল পরিদর্শন করে সহযোগিতা করেছেন।
জয়নালের টাকা নেই, কিন্তু মন আছে, ক্ষমতা নেই কিন্তু আছে মানবতা। তিনি প্রকৃতি মানুষ। সমাজ পরিবর্তনের মানুষ। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২৮ জুন ‘এসো বাংলাদেশ গড়ি’ শীর্ষক রোড শো চলাকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’ হিসেবে সনদ ও পদক দেওয়া হয়। মমতাজ হাসপাতালে নারীদের প্রসূতি রোগের চিকিৎসায় সহযোগিতা করছেন । ২০১৮ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত বরেণ্য বুদ্ধিজীবী গোলাম সামদানী পাঠাগারে সাপ্তাহিক জীবনের গল্প বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তার আলোকিত জীবনের বর্ণাঢ্য কাহিনী বলেন।
ময়মনসিংহ শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের দুর্গম ব্রহ্মপুত্র চরের ভেতর টান হাসাদিয়া গ্রামের এই মমতাজ হাসপাতাল পরানগঞ্জ ইউনিয়নের চার লক্ষাধিক মানুষ ছাড়াও বোররচর ও সিরতা ইউনিয়নের অন্তত ১০ লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার জন্য ভরসার স্থল হয়ে উঠেছে। জাহিদ হাসান জানান, প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৩০ জন রোগী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসছে। এই হিসেবে প্রতিমাসে গড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার রোগী আসছে এই হাসপাতালে। জয়নালের মমতাজ হাসপাতাল চর এলাকার মানুষের চেতনার বাতিঘর। এই জয়নালরা আছেন বলেই তো আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।