এগিয়ে চলছে মণিঋষিদের স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্র
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
একটি ভালো ও সময়োগযোগী উদ্যোগ কখনও ব্যর্থ হতে পারে না। এরকম উদ্যোগ মানুষকে স্বপ্ন দেখায়, তাদের সমস্যা সমাধান করে এবং আশাবাদী করে তুলে। এরকমই একটি উদ্যোগ নিয়েছেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার তরুণরা। মণিঋষিদের মাঝে শিক্ষা বিস্তার করা। ২০১৪ সালে মণিঋষিদের সংস্পর্শে আসেন এই তরুণরা। জানতে পারেন এই সম্প্রদায়ের মানুষের সন্তানেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা বংশপরম্পরায় নিরক্ষর থেকেই জীবন ও জীবিকা পরিচালনা করে আসছেন। নিরক্ষরতা ও দারিদ্র্যতার কারণে শিক্ষার মর্ম যেমন প্রবীণ মণিঋষিরা উপলদ্ধি করতে পারেননি ঠিক তেমনি কালেভদ্রে কেউ যদি শিক্ষার গুরুত্ব তাদের বুঝিয়েও দেন দারিদ্র্যতার কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেননি তারা। বরং সংসারের জন্য বাড়তি আয় নিশ্চিত করার জন্য শিশুদেরকেও তারা আয়মূলক কাজে নিয়োগ করেন। সঙ্গত কারণেই মণিঋষিরা নানান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার ভেতরে দিনাতিপাত করে আসছেন।
মণিঋষিদের এই সমস্যা জানার পর ২০১৫ সালে তরুণ উদ্যোগ নিয়ে তাদের সন্তানদের পড়াতে শুরু করেন। পড়ানোর জন্য নিদির্ষ্ট কোন স্থান না থাকায় খোলা আকাশের নীচে এই পাঠক্রম পরিচালিত হয়। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তরুণরা কচি মনের শিক্ষার্থীদের জন্য বই, খাতা, পেনসিল ক্রয় করেন। এভাবে দিনকে দিন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি এবং গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচন্ড দাবদাহের কারণে পাঠক্রম প্রায়ই ব্যাহত হয়। তরুণরা চিন্তা করেন কীভাবে এ সমস্যাটি সমাধান করা যায়। একপর্যায়ে তারা এলাকার শিক্ষানুরাগী, প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং বেসরকারি সংগঠনের সহযোগিতা কামনা করেন। তরুণদের এই উদ্যোগের পাশে এসে দাঁড়ায় এসব ব্যক্তি ও সংগঠন। তরুণদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্রের জন্য তারা ঘর নির্মাণের স্বপ্ন দেখে। বিভিন্ন মানুষ ও সংগঠনের সহযোগিতায় ঘরের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। তরুণদের এই ভালো উদ্যোগের সাথে শামিল হন কৃষকরাও। স্কুলঘরের জন্য একজন কৃষক জমি দান করেন, অন্যরা ঘরের জন্য উপকরণ দান করেন। এভাবে পাঠক্রম পরিচালনার এক বছরের মধ্যেই ঘর নির্মিত হয়। তবে শুধু স্কুল ঘর হলেই তো চলবে না। প্রয়োজন শিক্ষা উপকরণসহ বিভিন্ন সহযোগিতা। গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষানুরাগী এবং বেসরকারি সংগঠনের কাছে আবারোও সহযোগিতা চান তরুণরা। ওইসব ব্যক্তি ও সংগঠনের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের জন্য বই, কলম, খাতা, স্কুলের জন্য চেয়ার, বেঞ্চ ক্রয় করেন তারা।
অন্যদিকে লেখাপড়ায় সরকারি সুযোগ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় মণিঋষি শিক্ষা স্বাস্থ্য কেন্দ্র “মন্দিরভিক্তিক” শিক্ষার সাথে যুক্তকরণের জন্য আবেদন করেন উদ্যোগক্তারা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্দিরভিক্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতিনিধিগণ স্কুল পরিদর্শন করেন। কার্যক্রম দেখে সন্থষ্টি প্রকাশ করেন। সঙ্গত কারণেই এ বছর শুরুর দিকে শিক্ষা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো মন্দিরভিক্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা সরকারের তরফ থেকে বিনামূল্যে বই ও বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ লাভ করে। ক্ষুদ্র উদ্যোগটি আরও প্রসার লাভ করে। যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠদান করতেন তারা বেতন পেতে শুরু করেন। ছোট হলেও কর্মসংস্থান পেয়েছেন। স্কুল কার্যক্রম ও পাঠদান সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য তরুণরা নানাভাবে চেষ্টা করে যান। একপর্যায়ে তারা জানতে পারেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা” প্রকল্প রয়েছে। তারা এই সহায়তার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। তাদের এই আবেদনে সরকারের প্রতিনিধিগণ মণিঋষিদের স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, পাঠদান ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের পর্যবেক্ষণ একটি ইতিবাচক সংবাদ বয়ে আনে মণিঋষিদের জন্য। কেননা তাদের আবেদন গৃহীত হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন “বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা” আওতায় তারা সহায়তা পান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমে মণিঋষিদের জন্য সরকারের কাছ থেকে আসে দুই লক্ষ ষাট হাজার টাকা! সম্প্রতি বরাদ্দকৃত অর্থ মণিঋষি সম্প্রদায়ের শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নিকটে হস্তান্তর করেন হরিরামপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। বরাদ্দকৃত এ অনুদান ও শিক্ষাবৃত্তির পেয়ে মণিঋষি স্বাস্থ্য শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীরা খুশি, খুশি তরুণরাও। কেননা এই অর্থের মাধ্যমে তারা স্কুলের কার্যক্রম সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও শিক্ষকদের বেতন ও শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি প্রদান করতে পারবেন!
মণিঋষিদের জন্য গড়ে তোলা স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে শুধু পাঠ্যপুস্তকে অনুশীলনীগুলো পড়ানো হয় না; বরং স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেনতা, মানবিক গুণাবলী বিকাশসহ একজন সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব বিষয়ই শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানো হয়। এজন্য যারা এখানে পড়ান তাদেরকেও এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখতে হয়। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদেরও নানাভাবে সচেতন করে তোলার কাজ করা হয়। যেমন: বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদকাসক্ত, ইভটিজিংয়ের নেতিবাচক বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করে তোলা হয় অভিভাবকদের সভায়। এছাড়া পরিবেশ-প্রকৃতি, স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চাসহ নানান বিষয়েও আলোচনা হয় অভিভাবকদের এ সভায়। এর উদ্দেশ্য হলো; অভিভাবকরা যদি সচেতন হয় তাহলে তাদের সন্তানকেও তারা সচেতন করে তুলতে পারে এবং সন্তানরা ঠিকমতো লেখাপড়া করছে কি না সে বিষয়টিও তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
মণিঋষিদের এই স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলো এগিয়ে চলছে। দিনকে দিন শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। মণিঋষিদের ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সন্তানেরাও এখানে লেখাপড়া করছে। এছাড়া এই স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর সফলতা দেখে অন্যান্য এলাকার তরুণরাও পিছিয়ে পড়া শিশুদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে আগ্রহী ও উৎসাহিত হয়েছেন। অন্যদিকে মণিঋষি সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই স্বাস্থ্য শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর কারণে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা এখনও স্বপ্ন দেখতে সাহসী হয়েছেন। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে তাদের সন্তানেরা তাদের দারিদ্র্যতা দূর করবে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই প্রসঙ্গে কালই এর বাসিন্দা নিত্যমনি সরকার বলেন, “স্বপ্ন ছিল, পূর্ণ হয়েছে। আমরা সফল হয়েছি। আমাদের তৈরিকৃর্ত স্কুলে লেখাপড়া করছে আমাদের ছেলে মেয়েরা। আমাদের কাছে খুবই ভালো লাগে। ওরা লেখাপড়া করে, অনেক বড় হবে। আমরা আর পিছিয়ে থাকব না, আমরা সুখী হবো, আমাদেরকে অন্যান্য লোকজন সম্মান করবে। আমরা সবার সাথে মিশতে পারব, আমাদের বুকটা ভরে যাবে আনন্দে। এই আনন্দ আমরা সবাইকে জানাতে চায়।”
তরুণদের এই উদ্যোগ অন্য এলাকার তরুণসহ অন্য মানুষকেও উৎসাহিত করুক!