আঙ্গিনা রেমার একাগ্রতা ও উদ্যম
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
যখন বাড়িতে ঢুকছিলাম তখন দেখলাম জনমানবহীন একটি ইটের তৈরি ঘর অন্যটি মাটির দেওয়াল। রান্নাঘর পূর্বপাশে অনেক বড় একটি পুকুর যেখানে বিভিন্ন মাছেরা খেলা করছে। কিন্তু কোন মানুষ নেই; দু’টি ঘরে তালা দেওয়া একটি ছিটকিনি দেওয়া। উঠানের পাশে দা কোড়াল পরে আছে হয়তো লাকড়ি কেটেছিল কিছুক্ষণ আগে। দা কোড়াল বাইরে দেখে অনুমান করলাম হয়তোবা আশপাশেই কোথাও আছে। তারপর খোঁজাখুঁজি করে মানুষটির দেখা পেলাম। পুকুর পাড়েরর একটি আমন ধানের জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে সেখান থেকে গরুর জন্য কাচা ঘাস কাটছেন আপন মনে। ডাক শুনে উঠে আসলেন। তারপর জানতে চাইলাম তার জীবনের গল্প। শুরু করলেন এই বলে যে, তাঁর এই দুু তিন দিন হয় শরীর ভালো যাচ্ছে না। তারপরও গরুর জন্য ঘাস কাটছেন। বাড়িতে তিনি একা। দুই ছেলে লেখাপড়ার জন্য ময়মনসিংহ ও ঢাকায় অবস্থান করছে। তাই গরু দেখার মত কেউ নেই। তাই তো অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজেই কাজ করছেন। বলছিলাম কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রামের অধিবাসী আঙ্গিনা রেমার কথা।
স্বামী স্ত্রী দু’জনে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে তিলে তিলে খুঁজে নেন জীবনের চলার পথ। লেখাপড়া তেমন করতে পারেননি। বিয়ের কিছু দিন ভালোই চলছিল। কিন্তু এক সময় সংসারে ভাটা শুরু হল। স্বামী, স্ত্রী দু’জন মিলে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি সবজি চাষ করেন। মূলত সেখান থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চালান। তিলে তিলে জমানো কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে জমিজমা ক্রয় করা শুরু করেন। ক্রয়কৃত জমিতে ধান চাষ করে ধান থেকে চাল করে সেটা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। সব কাজ নিজেই করতেন। এভাবে যখন আসতে আসতে সংসার গোছাতে শুরু করছিলেন তখই হঠাৎ স্বামী মৃত্যু কোলে ঢলে পড়লেন। তারপর থেকে জীবনের আর এক অধ্যায় শুরু হল।
স্বামী রেখে যান দু’টি ছেলে সন্তান, কিছু জমি আর অসমাপ্ত পুকুর। স্বামী মারা যাওয়ার পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে সংসার চালাতে গিয়ে দুই ছেলের জন্য খাবার জোগার করতে আঙ্গিনা রেমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। সারাক্ষণ বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তার দিন শুরু হতো কোন কাজ দিয়ে আবার দিনও শেষ হতো কোন না কোন কাজের মধ্য দিয়ে। স্বামীর অসমাপÍ পুকুর খননের কাজটিও তিনি সম্পন্ন করেন। পুকুরে মাছের চাষ শুরু করেন। মাছ বিক্রি করতে গিয়ে অনেক হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। মাছের ন্যায্য মূল্য থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হতেন। অনেকসময় রাতের বেলায় তার পুকুর থেকে মাছ চুরি হতো। মাছ চাষে নানা কারণে সুবিধা করতে না পেরে তিনি প্রতিবছর এক বছরে জন্য পুকুরটি লিজ দিতে শুরু করেন, যা আজও চলমান। প্রতিবছর পুকুর লিজ দিয়ে যে টাকা পান সেটা দিয়ে সংসার ও দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালান।
পুকুর লিজ, শীতকালীন ও বর্ষাকালীন সবজি চাষ করেই মূলত আঙ্গিনা রেমা সংসার ও সন্তানের পড়াশোনা চালাচ্ছেন। তাঁর এক ছেলে এসএসসি পাশ করেছে। অন্য ছেলেটি এইচএসসি পাশ করে এখন পলিটেকনিকে লেখাপড়া করছে। আঙ্গিনা রেমা স্বপ্ন দেখেন একদিন তাঁর দুই সন্তান লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকুরি করবে। হয়তোবা সেদিন তার কষ্টের প্রহর শেষ হবে।