একজন প্রকৃতির সন্তান কৃষক দুলাল মিয়া

নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান

নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সম্পদ কাজে লাগিয়ে বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করে নিজের পরিবারে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করছেন ও বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিকরার মাধ্যমে নিজ বাড়িতে একটি শতবাড়ি মডেল ও প্রকৃতির পাঠশালা করে গড়ে তুলেছেন কৃষক দুলাল মিয়া।


ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার বিশকা ইউনিয়নের খিচা গ্রামের প্রকৃতির সন্তান কৃষক দুলাল মিয়া। কৃষিকাজ তাঁর পেশা। ছোটকাল থেকেই মাটির সাথে খেলা, প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক তাঁর। তাঁর আয় উপার্জনের পথ কৃষিকাজ। তাই বাড়ির চারপাশে ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছের বাগান গড়ে তুলে তৈরি করেছেন এক সবুজ প্রান্তর। হাঁস, মোরগ, কবুতর, ছাগল, গরু নানান জাতের পাখি সংরক্ষণ, পালন ও সম্প্রসারণ করছেন এই কৃষক। বারোমাসে বারো ফল দুলালের বাড়িতে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘বাজারের রাসায়নিক ফল আমি কিনে খাই না। নিজ বাগান থেকে আমি সন্তানকে ফল খাইতে দেই।’ তাঁর বাড়ির পাশে আছে আমড়া, কামরাঙ্গা, ডালিম, জলপাই, লেবু, তেতুল, সফেদা, চালতা, আম, জাম, আতাফল, জামরুর, ডালিম, কাঁঠাল, খেঁজুর, পেঁপে, বেল, নারকেল, জাম্বুরা, বিলেম্বু, তাল, পেঁয়ারা, লিচু, সুপারি, কমলা, বড়ই, কদবেলসহ নানা ফলের সমারোহ।


তিনি জানেন প্রকৃতিতেই আছে রোগের সমাধান। বাড়িতে রোপণ করেছেন অনেক ঔষধি গাছ। এলাকার মানুষের রোগ নিরাময়ে সহায়তার জন্য তিনি লেবু, অড়বরই, থানকুনি, আপন, ধুতুরা, হরতকি, তেজপাতা, পান, বাসক, লজ্জাবতী, খারাজুরা, নিম, গাছ দিয়ে অনেক রোগের চিকিৎসা সহযোগিতা করেছেন। প্রতিদিনই অনেক নারী, পুরুষ আসেন দুলালের বাড়িতে ঔষধি গাছের জন্য। বারসিক ঔষধি গাছ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন কৃষক দুলালকে। অনেক বনজ গাছ বাড়ির আনাচে কানাচে দেখতে পাওয়া যায়। বদ্দিরাজ, কালাউজা, বাঁশ, শীল কড়ই, শিমুল, বরুম, শেউড়া, রঙ্গি ইত্যাদি। তাঁর বাড়িতে আছে মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন মসল্লা ও তেলজাতীয় ফসলও যেমন: মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, গুয়ামুড়ী, ধনিয়া, তিল, সরিষা ইত্যাদি।


দুলাল মিয়া সারাবছরই নিজ বাড়িতে সবজি উৎপাদন করেন। অনেক বছর ধরে তিনি নিরাপদ সবজি উৎপাদন করেন, এসব সবজি নিজেও খেয়েছেনও। উদ্বুত্ব সবজি বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয়ও করেন। সারাবছর চাষ করেন ধুন্দল, মুখিকচু, পাটশাক,গোল আলু, মিষ্টি আলু, বেগুন, বাটিশাক, সিম, সাজনা, ঢেড়স, কাচা কলা, পুইশাক, কচু, লাউ, লালশাক, ডাটা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, টমেটো, করলা, মূলা, সরিষাশাক, বরবটি, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, কাকরুল, আলু শাক ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর মাঠেও ছায়া ফসলের মধ্যে রয়েছে আদা, হলুদ, মাছ আলু, গজআলু প্রভৃতি। অচাষকৃত উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বিলাতি ধনিয়া পাতা, কলমিশাক, এলুঞ্চি, দলকলস, কচু, খুরেশাক, কচুর লতা।


ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দুলাল মিয়া নিজের তৈরি কেচো কম্পোষ্ট, কুইক কম্পোষ্ট, গোবর এবং জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষক দুলালের সুনাম রয়েছে এলাকাবাসীর কাছে। এলাকার মানুষের কাছে দুলালের বাড়িটি একটি শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাড়িটি যেন একটি কৃষি শিক্ষা কেন্দ্র । প্রকৃতিকে জানা, চেনা ও বুঝার জন্য দুলাল মিয়ার বাড়ি একটি প্রকৃতির পাঠশালা। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাঁর বাড়িতে আসে গাছগাছালি চেনার জন্য, ওষধি গাছের জন্য। কৃষক আসেন সবজি চাষের তথ্য জানার জন্য, বীজ সংগ্রহের জন্য এবং পরামর্শ গ্রহণের জন্য। সাধুপাড়া জনউন্নয়ন কেন্দ্রে কৃষক বৈঠকে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন দুলাল মিয়া।


দুলালের বাড়িতে আছে কৃষির নানান উপকরণ, কাঁচি, ছেনি, দা, কুড়াল, কুন্তি, শাবল, কোচ, জুত্যা, পোলো, ঝাপুন, কুদাল, বেলচা,ইদুর মারার বাঁশের তৈরি ফাঁদ, হাতুরি, বাটাল, করাত, শিকল, দাঁড়িয়া, কুন, টানা, মাটির গর্তকরার যন্ত্র, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, বিন্দা, মাছধরার নানা উপকরণ, বীজ রাখার কলসি, মটকা, ছিক্কাসহ নানান লোকায়ত জ্ঞানে তৈরি নারী ও পুরুষের বানানো উপকরণ। অনেকেই তথ্যের জন্য, কৃষি, বীজ, ফসলের রোগবালাই, কৃষি অফিসের, প্রাণী সম্পদ অফিসের, মৎস্য অফিসের ডাক্তারের ঠিকানা জানার জন্য দুলালের কাছে আসেন।


কৃষক দুলালের বাড়িটি একটি শতবাড়ি মডেল। একটি পুষ্টি বাড়ি। তার বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে ব্যবহার করেছেন উৎপাদনে। বাজারের উপর নির্ভরশীলতা তাঁর নেই। নিজের সম্পদ, জ্ঞান ব্যবহার করে জীবনযাত্রাকে সচল রেখেছেন, নিরাপদ খাদ্যের আশ্রয়স্থল গড়ে তুলেছেন। দুলালের এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। তাঁকে দেখে আরও অনেকে অনুপ্রাণীত হোক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করার, পরিবেশ সুরক্ষা করার এবং সর্বোপরি নিজের এবং মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখার।

happy wheels 2

Comments