বৈশাখী মেলা: মানিকগঞ্জের গ্রামীণ জনপদে প্রাণের ছোঁয়া
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
আসছে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালির দ্বারে আরো একটি নতুন বছর। পহেলা বৈশাখকে বরণ করতে আনন্দে মেতে উঠে বাঙালি জাতি। তারই ধারাবাহিকতায় মানিকগঞ্জের গ্রামীণ জনপদের মানুষজনের মাঝে বইছে প্রাণের ছোঁয়া। বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ বরণ ও উদযাপনে অবিচ্ছেদ্য অংশ মেলা।
পহেলা বৈশাখ আর বৈশাখী মেলা যেন এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে প্রাণের স্পন্দন হয়ে আছে। বাঙালির কৃষ্টি কালচার আর ঐতিহ্য নিয়ে বর্ণিল সাজে মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশের আয়োজন ও গ্রামে-গ্রামে বৈশাখী মেলা আয়োজনের মাধ্যমে এখানে চলে বর্ষবরণ। আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য এই মেলা। মেলায় নানা স্বাদের মুড়ি-মুড়কি আর পিঠা-পুলি তো রয়েছেই, সেই আদিকাল থেকে জনপ্রিয় পুতুল নাচের আসরও এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। আর নাগরদোলায় হাওয়ায় ভেসে নববর্ষের নতুন মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার অনুভুতি যেন একেবারেই ভিন্ন।
এছাড়া রয়েছে হরেক রকমের কুটির শিল্প আর হস্ত শিল্পের বাহারি প্রদর্শনী। দেখা মেলে বাংলার ঐতিহ্য মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্যের। এ মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক, আবহমান বাংলা ও বাংলাদেশের প্রতিমূর্তি। সময়ের প্রবাহে মোগল প্রবর্তিত বাংলা নববর্ষের উদযাপন-আয়োজনে এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলায়ও।
চৈত্র সংক্রান্তি থেকে পুরো বৈশাখ মাসজুড়ে বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নববর্ষের বৈশাখী মেলা। জেলার বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে অর্ধশত মেলা আসর জমবে নববর্ষে। আর এ মেলাকে সামনে রেখেই জেলার প্রায় ৩০ হাজার তাঁত, হস্ত ও মৃৎশিল্পী আর মিষ্টির কারিগর আর ভ্রম্যমান পসরা বিক্রেতারা পাড় করছেন ব্যস্ত সময়।
প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে ব্যাপক আড়ম্বতায় শুরু হয় মেলা। এসব মেলা গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সাথে জেলা ও উপজেলা শহরেও বসে বেশ কয়েকটি মেল। হরেক পসরা আর প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ছাড়াও এসব মেলায় থাকে পালা গান, লোকজ যাত্রাপালা, সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি, পুতুল নাচসহ নানাবিধ লোকজ প্রদর্শনী। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ভরে যায় মেলা অনুষ্ঠিত এলাকায়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন আর নতুন পোশাকাদীতে চারদিকে বয়ে যায় নব উৎসবের ঢেউ।
বৈশাখী মেলার অন্যতম আকর্ষণ মাটির তৈরি খেলনাসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র। বৈশাখী মেলায় মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র বিক্রির প্রস্তুতি নিতে চৈত্র মাসের শুরু থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঘিওর উপজেলাসহ জেলার প্রায় ৪ সহ¯্রাধিক মৃৎশিল্পী। বাড়ির পুরুষদের কাজে সহযোগিতা করতে ঘরে বসে নেই ওইসব পল্লীর রমণীরা। বৈশাখী মেলার খেলনা তৈরির মাধ্যমে হাতেখড়ি দিচ্ছে পাল পাড়ার ভবিষ্যত প্রজন্মের শিশুরাও।
কর্মমুখর কুমার পাড়ায় কোথাও হচ্ছে মাটি থেকে কাদা তৈরির কাজ, কোথাও হচ্ছে নানা আকারের পাত্র তৈরি। পণ্য তৈরি শেষে শুকানো হচ্ছে তা। সবশেষে দেয়া হচ্ছে রঙ তুলির আঁচড়। এখানকার পণ্য নিয়ে কুমাররা বেরিয়ে পড়বেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশাখী মেলায়। সেসব মেলায় নিজেদের বানানো পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করবেন তারা। ঘিওরের পাল পাড়ার মৃৎশিল্পী, তরণী পাল, প্রবীণ সুখেন পাল ও গৃহবধূ শিল্পী রানী পাল জানান, তারা প্রত্যেকেই মেলার জন্য মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলনা ও তৈজসপত্র তৈরি করছেন। চাহিদার কথা চিন্তা করে পুতুল, ব্যাংক, আম, কাঁঠাল, হরিণ, ঘোড়া, হাতি, মাছ, ময়ুর, সিংহসহ হরেক রকম শিশু খেলনা, ঘর গৃহস্থালীর হাড়ি, পাতিল, ঢাকনা, ঝাজর, কলসসহ নানান তৈজসপত্র, ঘর সাজানোর জন্য ফুলদানি, টবসহ নানান জিনিসপত্র তৈরি করছেন।
উপজেলার জাবরা পালপাড়া এলাকার প্রমীলা রানী পাল বলেন, “আমাদের এ এলাকায় আগে আরো অনেক পরিবার ছিল যারা এ শিল্পের মাধ্যমে জীর্বিকা নির্বাহ করেছে। কিন্তু এখন আর কেউ এ ব্যবসায় থাকতে চায় না। সামনে পহেলা বৈশাখ। আর তাই আমাদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। দিন-রাত এক করে কাজ করতে হচ্ছে। এ মেলা আমাদের আয়ের বড় একটি উৎস।”
এছাড়াও সারাদেশেই রয়েছে মানিকগঞ্জের মিষ্টির কদর। হরেক স্বাদের মিষ্টি ছাড়া বৈশাখী মেলা কল্পনাও করতে পারে না মানিকগঞ্জের লোকজন। রসগোল, জিলাপী, দধি, মাসকলাই আমিরতী, রসমালাই, সন্দেশ, কালোজাম, চমচম তৈরি করতে দুধ, চিনি, গুড়, মাসকলাইসহ অন্যান্য উপকরণ ক্রয় এবং মিষ্টি তৈরি করার কাজে দম ফেলার ফুসরত নেই ঘোষপাড়ার নারী-পুরুষদের। জেলায় এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ৬ হাজার লোক।
জেলার ৭টি উপজেলাতেই রয়েছে কম বেশি তাঁতশিল্প। বৈশাখী শাড়ি, লুঙ্গি, বাহারী রঙের গামছা তৈরির কাজে মানিকগঞ্জের তাঁত শিল্পীদের ঘুম নেই চোখে। এছাড়াও মানিকগঞ্জের সিল্ক, মসলিন, থানকাপড় ও কারু কাজ সমৃদ্ধ শাড়ির কদর দেশজুড়ে। তাঁত মালিক আবদুল বাসেত মিয়া জানান, মালিক-শ্রমিক মিলে প্রায় ১০ হাজার লোক এ পেশার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
তাঁত শ্রমিক আজমত মল্লিক জানান, দিনপ্রতি ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার করছেন একেকজন শ্রমিক। তবে পয়লা বৈশাখ ও ঈদ-পূজায় রোজগার বেড়ে যায়। কুটির শিল্পীরা বাঁশ-বেত সামগ্রী, রঙিন হাতপাখা, মোড়া, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, শিশুদের খেলনা সামগ্রীসহ ঘর গৃহস্থালির নানাবিধ উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার ২ হাজারেরও বেশি পরিবার। তাদের চোখে স্বপ্ন এসব পণ্যসামগ্রী নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করবেন তারা।
মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি গোলাম ছারোয়ার ছানু বলেন, “আগে কয়েকটি গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে, অথবা নদীর ধারে, বটতলায় বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো। এসব মেলায় নামতো হাজার হাজার মানুষের ঢল। মেলায় থাকতো কাঁচের চুড়ি, রঙ-বেরঙের ফিতা, তাঁতের শাড়ি, নকশা করা হাতপাখা, কামার ও কুমোরের দোকান, মুড়ি-মুড়কি-খই, সন্দেশ, বাতাসা, মিষ্টি, মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, ঘুড়ি, নাটাই, গুলতি, অলংকার, তৈজসপত্র, বেলুন, বাঁশি, ফলমূল ইত্যাদি। আর বিনোদনের জন্যে থাকতো নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, জারি-সারি-ভাটিয়ালি গানের আসর, কবিগান, ষাড়ের লড়াই, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ, কুস্তি খেলা ইত্যাদি। তবে দিন দিন এসব সুখস্মৃতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে।”
ঘিওরের রাধাকান্তপুর মেলা কমিটির আহবায়ক মীর কায়সার হামিদ বলেন, “নববর্ষ উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারো ৭দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ মেলা হয়ে উঠে গ্রামীণ ও শহরের মানুষের প্রাণের উৎসব।”
পহেলা বৈশাখ উদযাপনে আমাদের জাতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যের সামগ্রিক প্রতিচ্ছবির দেখা মেলে। একদিকে যেমন উৎসবে মেতে ওঠে নবীন-প্রবীণ, শিশু ও কিশোররা; অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নতুন প্রজন্মও পরিমার্জিত ধারণা লাভ করতে পারে।