রাসায়নিক কৃষি: কৃষি ও কৃষককে বিপন্ন করেই চলেছে

সিলভানুস লামিন

ভূমিকা
ধান ছাড়া এশিয়াবাসীদের জীবনের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। আমরা প্রতিদিন নাস্তার জন্য, দুপুরের খাবারের জন্য, রাতের খাবারের জন্য এবং এমনকি হালকা জলখাবার বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের জন্য ধান ব্যবহার করি। বিশ্বের প্রায় অর্ধেকের মতো জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য হচ্ছে ধান এবং কৃষিকাজ, বিশেষ করে ধান চাষ করে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই মানুষেরাই ধান উৎপাদন করে এখনও আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। তবে তাদের এই কঠিন পরিশ্রমের ফল হিসেবে সুবিধা বা লাভবান হওয়ার চেয়ে তারা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে আরও বেশি দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত। একদিকে তারা রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও বাণিজ্যিক পণ্যের দামের কারণে দিশেহারা হচ্ছেন অন্যদিকে এসব উপকরণ ব্যবহারের কারণে তাদের জমি ধীরে ধীরে বন্ধ্যা হতে শুরু করেছে। আমরা যে ভাত খাই সেটি আসলে বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানে মিশ্রিত এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের খাদ্য তালিকায় ঐতিহ্যবাহী ধান বলতে গেলে উধাও হয়েগেছে এবং এর জায়গায় তথাকথিত আধুনিক উচ্চ উৎপাদনসম্পন্ন ও হাইব্রিড ধানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

HIVs (High Input Varieties) প্রবর্তনের পর থেকে এশিয়ার বেশির ভাগ জাতীয় সরকারগুলো এই প্রজাতির ধান নিজের দেশে প্রবর্তনের সুপারিশ করে। দেখা যায়, ১৯৭০ সালের মধ্যে এশিয়ার ৩০% কৃষিজমি ঐওঠং-র আওতায় আসে এবং ১৯৯০ সালে এই প্রজাতি এশিয়ার দেশগুলোর প্রায় ৭০% কৃষিজমিতে আবাদ করা হয়। উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদের পর প্রাথমিকভাবে প্রচুর ফলন হওয়ায় আধুনিক কৃষির প্রবক্তারা দাবি করেছেন যে, এশিয়ার কোটি কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধা থেকে রক্ষা পেয়েছে যদিও সবুজ বিপ্লবের কয়েকটি দশক পার হওয়ার পর দেখা গেছে যে, এশিয়ায় দারিদ্র্যের পরিস্থিতি আরও নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। ২০০০ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সবুজ বিপ্লবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের হার ১১% বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও)’র তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে সারাবিশ্বে ৯৬৩ মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষ ছিলো। ফাও বলেছে, খাদ্য উৎপাদন নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেলেও সবুজ বিপ্লব সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের সত্যিকারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কল্যাণ আনয়নে কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রবর্তিত আধুনিক কৃষি কীভাবে সাধারণ কৃষাণ-কৃষাণী ও আদিবাসীদের জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করেছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং কম উৎপাদন
IRRI উদ্ভাবিত HIVs প্রজাতির ধান উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার, কীটনাশকের প্রয়োজন হয়। এ প্রজাতির ধান নজিরবিহীন হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। ১৯৭৯ সালে এশিয়ায় প্রতি হেক্টর জমিতে যেখানে মাত্র ৫২ কেজি সারের প্রয়োজন হয়, ১৯৯৯ সালে এসে এই হার বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি হেক্টরে ১৩৮ কেজিতে দাঁড়িয়েছে অর্থ্যাৎ প্রায় তিনগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত রাসায়নিকনির্ভর কৃষিব্যবস্থা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির করার পাশাপাশি এটি বিদ্যমান ভূমিহীনতার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলশ্রুতিতে কৃষকরা দারিদ্র্য পরিস্থিতির দিকে আরও গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়েছে। কৃষিখাতে অতিরিক্ত উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন বেশি না হওয়ায় অনেক কৃষক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বিধায় ভারতে চারদিক থেকেই নৈরাশ্য বিরাজ করেছে। এই ঋণগ্রস্ততার কারণে নিরাশ হয়ে দেশটিতে ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোট এক লাখ ৫০ হাজার কৃষকের আত্মহত্যা করেছে এবং এ প্রবণতা এখনও বিদ্যমান রয়েছে।

অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে HIVs প্রজাতির ধান প্রচুর ফলন দিলেও এর জন্য অনবরতভাবে এবং উচ্চ হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে মাটি বন্ধ্যা বা অনুর্বর হয়ে পড়েছে। এর ফলে এশিয়ায় ধান গাছের বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭৭ সালে যেখানে গড়ে ধান গাছের বৃদ্ধি ৩.৪% সেখানে ১৯৯৭ সালে এসে গড়ে ধানগাছের বৃদ্ধি মাত্র ১.৫%। ধানের পোকামাকড়রোধী ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক কৃষির প্রবক্তারা আরও নতুন ধরনের HIVs প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করে যেগুলোর আবাদে প্রথমগুলোর তুলনায় আরও বেশি কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োগ প্রয়োজন হয়। ভারতে IRRI উদ্ভাবিত বেশির ভাগ HIVs প্রজাতির ধান পোকামাকড় ও রোগবালাইপ্রবণ হওয়ার ঘটনা পাওয়া গেছে যেখানে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণের শিকার হয়ে ৩০% থেকে ১০০% পর্যন্ত শস্য-ফসলহানী হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। অন্যদিকে ২০০৭ সালে ভারতের পাঞ্জাবে IRRI উদ্ভাবিত সবচে’ সাম্প্রতিক প্রজাতির ধান আবাদ করে দেখা গেছে যে, এই ধান ৪০ প্রকারের পোকামাকড় এবং ১২ ধরনের রোগবালাইপ্রবণ।

স্বাস্থ্য সমস্যা
আধুনিক কৃষির কল্যাণে কৃষি শ্রমিকেরা প্রতিদিন বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শতায় আসার কারণে তারা নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সমগ্র এশিয়ায় কৃষির সাথে জড়িত জনগোষ্ঠীরা রাসায়নিক কীটনাশকের সংস্পর্শতায় নানান দৌর্বল্যকর স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে; তীব্র ও দীর্ঘকালীন কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। তীব্র কীটনাশক বিষক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মাথা ঘোড়া, মাথা ব্যথা, বমিভাব, তলপেটের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, সাধারণ অবসাদসহ আরও অন্যান্য উপসর্গ। অন্যদিকে দীর্ঘকালীন রাসায়নিক কীটনাশক বিষক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে চর্মরোগ, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও বিপাকতন্ত্রের অস্থিতিশীলতা, স্নায়ুরোগ, ক্যান্সার এবং প্রজননতন্ত্রের অস্বাভাবিক কার্যাবলী। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সারাবিশ্বে প্রতিবছর ৪১৬ মিলিয়ন মানুষ রাসায়নিক কীটনাশক তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। শুধুুমাত্র কৃষিশ্রমিকরাই যে কীটনাশক বিষক্রিয়া আক্রান্ত তা কিন্তু নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮৯ সালে হিসাব করে দেখিয়েছে যে, প্রতিবছর ৩ মিলিয়ন মানুষ তীব্র কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত এবং এর মধ্যে ২০,০০০ জন মৃত্যুবরণ করেছে। তবে সা¤প্রতিক যে হিসাবটি করা হয়েছে তাতে রাসায়নিক কীটনাশকের তীব্র বিষক্রিয়ায় সংখ্যা পূর্বের সব সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। ওই হিসাব মতে, প্রতিবছর ২৫ মিলিয়ন মানুষ রাসায়নিক কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।

প্রতিবেশ ধ্বংস ও প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্তি
ধানক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার কেবলমাত্র কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট করেনি সাথে সাথে এই বিষাক্ত পদার্থ প্রতিবেশকে ধ্বংস করছে। পানির উৎসসমূহ, উপকারি পোকামাকড়, জীবাণু, অরণ্যজীবন রাসায়নিক কীটনাশকের কারণে ধ্বংস হচ্ছে। ডিডিটি এবং dieldrin (যেসব কীটনাশক দীর্ঘদিন পরিবেশে বিরাজ করে) এর অবশিষ্টাংশ খাদ্যচক্রের সাথে পাওয়া যাচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহার অবশ্য ধানক্ষেতের মাছ ও সবুজ শাকসবজিকেও নষ্ট করে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে গরিব মানুষের খাদ্য তালিকায়। অন্যদিকে কীটনাশক ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পানি সম্পদের ওপর। রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে সুপেয় পানিতে মাতাতিরিক্ত পর্যায়ে নাইট্রেট-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে এবং হাইব্রিডসহ অন্যান্য HIVs প্রজাতির ধানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করে সেচ দেওয়া হয় বলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নীচে নেমে গেছে। অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে মাটির লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। চীন ও পাকিস্তানে সেচাধীন প্রায় ২০% কৃষিজমি লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে।

অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের এ যাবৎকালের সবচে’ মর্মান্তিক ফলাফল হয়তো এশিয়ায় হাজার হাজার স্থানীয় প্রজাতির ধান বিলুপ্তিকে বিবেচনা করা যায়, যা IRRI-র HIVs প্রজাতির সূচনা ও প্রবর্তনের কারণে হয়েছে। কৃষকেরা বংশপরম্পরায় হাজার হাজার প্রজাতির ধান আবাদ ও সংরক্ষণ করতেন তবে সবুজ বিপ্লব, বিশেষ করে  HIVs  প্রজাতি সুচনা ও প্রবর্তনের ৩০ বছর পর কৃষকরা আবিষ্কার করেন যে, তাদের আবাদকৃত ওই সব হাজার প্রজাতির ধানের মধ্যে অনেকগুলোই বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে ম্যালয়েশিয়া এবং পাকিস্তানের ৯০% কৃষিজমিতে, মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের ৫০% কৃষিজমিতে এবং চীন ও ইন্দোনেশিয়ার ২৫% কৃষিজমিতে মাত্র ৫ প্রকার  HIVs  প্রজাতির ধান আবাদ হচ্ছে। কম্বোডিয়ায় একটিমাত্র  HIVs  প্রজাতির ধান ওই দেশটির শীতকালীন মৌসুমের ৮৪% কৃষিজমিতে আবাদ হচ্ছে। HIVs  প্রজাতির ধান শুধুমাত্র দামী ও রোগবালাই এবং পোকামাকড়প্রবণই নয়; বরং এই প্রজাতির ধানগুলোর শস্যমান নিম্ন এবং সুস্বাদু নয়।

ইন্টারনেট অবলম্বনে

happy wheels 2

Comments