ঋতু পাইজাম ধান কৃষকের কাছে পছন্দনীয় হয়ে উঠছে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
পাঠ্য পুস্তকের জ্ঞান আর প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সভ্য সমাজের মানুষেরা কেতাবি বিদ্যায় পারদর্শী। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকগণ প্রকৃতি থেকে যে শিক্ষা গ্রহণ করেছে, সেটাই হলো আসল শিক্ষা। কৃষকের ধ্যান, জ্ঞান সবকিছু নিজেদের সংগ্রহে বিভিন্ন ধানের বীজ থাকা স্বত্তেও তাঁদের মাচায় (ধান রাখার বাঁশ দিয়ে তৈরী বড় পাত্র বিশেষ) নতুন নতুন ধান জাত দিয়ে বীজ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে চায়।
কৃষি যেহেতু আমাদের আদি পেশা এবং নারীর হাত ধরেই এর উদ্ভব তাই কৃষিকাজের অনেক বিষয়েই আজ নারীর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া হয়। কোন জমিতে কি ধরণের বীজ চাষ হবে বা কোন জাত কতটুকু পরিমাণ সংরক্ষণ করা হবে এ বিষয়ে নিজ পরিবারে তাঁরা মতামত দিতে পারছেন। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের সুলতানগাতি গ্রামের একজন কৃষাণী হালিমা আক্তার, তাঁর পরিবারের একজন পরামর্শদাতা। তিনি নিজ হাতে সকল ধরণের বীজ সংরক্ষণ করেন। কৃষিকাজে তিনি স্বামী ও ছেলেদের পরামর্শ দেন। তাঁর কথা মতোই ২০১৭ সালের আমন মৌসুমের শুরুতে বারসিক রামেশ্বরপুর রিসোর্স সেন্টার থেকে সুবাশ ও ঋতু পাইজাম নামের দুই জাতের ধান বীজ নিয়ে যায়। যা ঐ মৌসুমে তাদের জমিতে চাষ করা হয়। কিন্তু তাদের নিচু জমি থাকার কারণে বৃষ্টির পানিতে ধান ক্ষেত তলিয়ে যায়। সুবাশ ধানটি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তবে ঋতু পাইজাম জাতের ধানটি একেবারে নষ্ট না হলেও তেমন ভালো ফলন আসেনি। ১২ শতাংশ জমি থেকে মাত্র ৩ মণ ধান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।
প্রথমবার যেহেতু ভালো ফলন পাননি। তাই সেই ধান থেকে ১০ কেজি’র মতো ধান বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করেছিলেন। আর বাকি ধানের চাল করে ভাত রান্না করে খেয়েছেন। রান্নার সময় একটি বিষয় তিনি খেয়াল করেন যে, নতুন চালের ভাত খুব নরম হয়। খেতে চান্দিনা নামক ধানের ভাতের মতো স্বাদ হয়। আর চাল একটু পুরনো হলে এই চাল দিয়ে খুব ঝরঝরে ভাত হয়। তিনি তাঁর প্রতিবেশিদের সাথে এই ধানের ভাত নিয়ে গল্প করেন। গল্প শুনে তিনজন প্রতিবেশি অন্য জাতের চালের সাথে এই চাল বিনিময় করেন। কারণ এই নরম ভাত রোগীর পথ্য হিসেবে তারা ব্যবহার করেছেন। প্রতিবেশিদের অনুরোধে এবং নিজের আগ্রহে তিনি ঋতু পাইজাম জাতের ধানটি এই বছর আমন মৌসুমে চার কাঠা (৪০ শতাংশ) জমিতে আবার চাষ করেছেন।
ধান মাড়াইয়ের পর দেখা যায় প্রতি ১০ শতাংশ জমিতে প্রায় সাড়ে চার মণ করে ধান উৎপাদন হয়েছে। রোদে শুকিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ধান পাবেন। এবছরও তিনি আগামী মৌসুমের জন্য বীজ ধান সংরক্ষণ করবেন। ঋতু পাইজাম ধানটি কাটার সময় আশেপাশের গ্রাম থেকে কয়েকজন কৃষক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে তিনজন কৃষক এই ধানের বীজ চেয়েছেন।
এ বছর তারা ব্রি-২৮, ৩২, ৪৯ ও পিঁপড়ার চোখ জাতের ধান চাষ করেছেন। অন্যান্য ধান জাতের পাশাপাশি সুলতানগাতি গ্রামের এই কৃষক পরিবারে আরো একটি নতুন ধান (ঋতু পাইজাম) যুক্ত হয়েছে। এর ফলনে তারা খুব খুশি। কারণ তাঁরা দেখেছেন অন্যান্য উফশী ধান চাষ করলে বীজ কিনতে হয়। কারণ প্রতিবছর একই বীজে উৎপাদন ভালো হয়না। তাছাড়া সার, বিষ দিতে গিয়ে কৃষিকাজে খরচও দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় জাতের ধান চাষে উৎপাদন কম হলেও খরচও তেমন করতে হয় না। সবচে’ বড় কথা হচ্ছে বীজ কিনতে হবে না।
একদিকে সুস্বাদু ভাত এবং অন্যদিকে উৎপাদন ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে ঋতু পাইজাম জাতটি এই পরিবার প্রতিবছরই চাষ করবে। তাছাড়া প্রথম বছর যেহেতু বৃষ্টির কারণে এই ধান চাষে কোনো ফলাফলে তাঁরা পৌঁছাতে পারেনি, তাই এবছর চাষে আশানুরূপ ফলন পেয়েছেন। তবে কৃষক রতন মিয়া মনে করেন, তাঁর এই জমিটি যদি একটু উঁচু হতো তাহলে আরো অধিক উৎপাদন হতো। আগামী মৌসুমে উঁচু জমিতে চাষ করবেন।
নেত্রকোনা জেলার রামেশ্বরপুর গ্রামের কৃষকগণ ২০০৫ সাল থেকে ধান গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাঁদের মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেমন স্থানীয় জাত সংগৃহীত হয়েছে, তেমনি আবার তাঁদের দ্বারাই এই বীজগুলো আমাদের বিভিন্ন কর্ম এলাকার কৃষকের ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে। এই হারিয়ে যাওয়া ধান জাতগুলো আবার আমাদের কাছে ফিরে আসছে এবং আমাদের শস্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করে তুলছে।