সাথী ফসলের চাষ: একটি স্থানীয় চর্চা
নেত্রকোণা থেকে হেপী রায়
কৃষি কাজে সামান্য হেরফের ঘটিয়ে কৃষকেরা একদিকে মাটির গুণাগুণ যেমন ঠিক রাখছেন, তেমনি ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। এগুলো কোন কোন এলাকার কৃষকদের স্থানীয় চর্চা বা লোকায়ত জ্ঞান নামে অভিহিত। কিছু চর্চা এ রকম যেমন, সময়ের একটু আগে বা পরে বীজ রোপণ, ফসলের আবর্তন বা শস্যাবর্তন, মিশ্র চাষ, সঠিক বাছাইয়ের মাধ্যমে নিজস্ব পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, নিয়মিত ও পরিমিত সারের ব্যবহার, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ এবং সাথী ফসলের চাষ। এই লেখায় সাথী ফসল চাষের বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। মূলত চাষকৃত ফসলের মধ্যে এমন কিছু উদ্ভিদ আছে যারা পাশাপাশি থাকলে একে অপরকে সাহায্য করে, রোগ পোকা ও আগাছা দমন করে। সাথী ফসল চাষের উদ্দেশ্যই হলো তাদের ওই কার্যকারিতা কাজে লাগানো। এইসব উদ্ভিদ একে অপরকে রক্ষা করতে তাদের গন্ধ, রঙ, পাতার আকার আকৃতি ও উচ্চতাকে কাজে লাগায়। টমেটো ও গাজর, গাজর ও মটরশুটি, মরিচ ও ধনিয়া বা গুয়ামুড়ি, টমেটো ও পিঁয়াজ এ রকম কয়েকটি সাথী ফসল যারা একে অপরকে পছন্দ করে। এই লেখায় সাথী ফসল হিসেবে মরিচ ও ধনিয়া চাষের সুফল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
মরিচ ও ধনিয়া চাষ
প্রত্যেক জমিতে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করার জন্য তাদের কিছু প্রাকৃতিক শত্রু বা চাষীর কিছু বন্ধু পোকা, প্রাণী ও অণুজীব থাকে। এই অণুজীবগুলো ক্ষতিকর পোকাকে বাড়তে দেয় না। রাসায়নিক কীটনাশক এদের উভয়কেই মেরে ফেলে। কিন্তু সুস্থ সবল ফসল প্রাপ্তি, সঠিক উৎপাদন এবং মাটির গুণাগুণ বজায় রাখার জন্য এই সব বন্ধুদের বাঁচাতে হবে ও বাড়তে দিতে হবে। নেত্রকোণা অঞ্চলে কে, কবে, কখন থেকে মরিচ ক্ষেতের চারপাশে ধনিয়া বা গুয়ামুড়ি চাষের প্রচলন শুরু করেছিলেন তার সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেনি। তবে রবি মৌসুমে যারা মরিচ চাষ করেন তারা প্রত্যেকেই তাদের জমির চারপাশে ধনিয়া না হয় গুয়ামুড়ি চাষ করেছেন।
ধনিয়া/ গুয়ামুড়ি চাষের সুবিধা
দেশিউড়া গ্রামের কৃষক ফজলু মিয়া বলেন, “মরিচ ক্ষেতের কিনারায় ধইন্যা লাগাইলে ক্ষেতে পোকা লাগে না। কারণ ধইন্যা গাছের এক রকমের উগ্র গন্ধ আছে। সেই গন্ধের লাইগ্যা পোকা মাকড় কাছে আসতে পারে না। চার কিনারায় লাগানোর অর্থ হইলো কোন দিক দিয়া পোকা ঢুকতে গেলেই গন্ধের কারণে ঢুকতে পারবে না।” তিনি আরও বলেন, “মরিচ ক্ষেতে এক ধরণের কিড়া পোকা থাকে যা গাছ বড় হইলে গাছের গোড়া কাইট্যা দেয়। ধইন্যা লাগাইলে একদিকে যেমন মরিচ ক্ষেতের পোকা দূর হয় অন্যদিকে তেমনি আরো একটি ফসল পাওয়া যায়, যা দিয়া পরিবারের ঐ মসলার চাহিদা মিটে।” তিনি এটি শিখেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। ধনিয়া বা গুয়ামুড়ি এমন একটা মসলা যা তরকারিতে খুবই সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয়। ক্ষেতের চারপাশে লাগালে তা থেকে যে ফলন আসে সেটা দিয়েই একটি পরিবারের সারাবছরের চাহিদা মেটানো সম্ভব। একদিকে জমির সুষ্ঠু ব্যবহার, পোকার আক্রমণ ঠেকানো এবং অন্যদিকে একই সাথে দুইটি ফসল পাওয়া যায়।
মরিচের কিছু অসুখ ও পোকা মাকড়
মরিচের গাছ যখন একটু বড় হয় তখন এক প্রকার পোকা গাছের গোড়া কেটে দেয়। বইয়ের ভাষায় এই পোকাকে ‘ক্যাটার পিলার’ বলে। এটি আক্রমণ করলে অনেক সময় জমিতে বেশি পরিমাণ পানি দিলে এই পোকা মরে যায়। অনেক কৃষক এ পদ্ধতিও অবলম্বন করেন, যখন কোন কারণে জমিতে ধনিয়া দিতে পারে না অথবা আশানুরূপ ধনিয়ার চারা গজায় না। এছাড়া মরিচ ক্ষেতে পাতা মোড়ানো রোগের আক্রমণ হয়। মরিচের দাগ রোগ, গোড়া পঁচা, ফল পঁচা ইত্যাদি রোগের আক্রমণ ঠেকানো যায় ধনিয়া/গুয়ামুড়ি চাষের মাধ্যমে।
বহু বছরের চর্চার মাধ্যমে আমাদের কৃষকগণ টিকিয়ে রেখেছেন তাদের ফসল বৈচিত্র্য, ঘরের খোরাক (খাবারের যোগান), পরিবেশের ভারসাম্য, জমির উর্বরতা। শুধু লোকায়ত চর্চা নয়, কৃষকদের সর্বাগ্রে উচিৎ জমির মাটিকে সুস্থ, সবল রাখা। কারণ সুস্থ ও সজীব জমিতে কীট-পতঙ্গের জন্ম বা রোগবালাই হয় না। জমিতে উপর্যপুরি রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমি তার স্বাভাবিক জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলছে। ফলে শস্য রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ জমিতে শুধু ক্ষতিকর পোকাই নয়, প্রচুর উপকারী পোকামাকড়ও থাকে। রাসায়নিক কীটনাশকের কারণে অনিষ্টকারী পোকা মাকড়ের সঙ্গে উপকারী পোকা মাকড়ও ধ্বংস হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, ঐসব উপকারী পোকামাকড় জমির জীবনীশক্তি বৃদ্ধি করে যার কারণে শস্যও সমৃদ্ধ হয়।