ধানসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য: সঙ্কট ও প্রস্তাবনা
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ধান আমাদের এক প্রধান কৃষিফসল। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% এবং শহরের ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার আছে। ধান, পাট, তুলা, আখ, ফুল ও রেশমগুটির চাষসহ বাগান সম্প্রসারণ, মাছ চাষ, সব্জি, পশুসম্পদ উন্নয়ন, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, বীজ উন্নয়ন ও বিতরণ ইত্যাদি বিষয়সমূহ এ দেশের কৃষি মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের কর্মকান্ডের অর্ন্তভূক্ত। কৃষিক্ষেত্রে দিন দিন রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও জাতীয় বাজেট কমছে। কয়েক বছর আগে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ছিল ১৯.১% এবং এ খাতের মাধ্যমে ৪৮.১% মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান দাঁড়িয়েছে ১৪.২৩%। রাষ্ট্র কৃষিকে দেখে খাদ্য উৎপাদনের মূলখাত হিসেবে। ২০১৩ সালের ভেতর সকলের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ‘ভিশন ২০২১’ গ্রহণ করে। কৃষি কেবলমাত্র এককভাবে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নয়; দেশের মানুষের আয় এবং কর্মসংস্থান নিশ্চিত করণের পাশাপাশি প্রতিটি বাস্তুসংস্থানের অপরাপর জীবিত প্রাণসত্তার বেঁচে থাকাকে সহায়তা করে। বিস্ময়করভাবে দেশে ধানসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে। মানুষ এখন না খেয়ে নেই। এটি সম্ভব হয়েছে দেশের পরিশ্রমী কৃষকসমাজসহ রাষ্ট্রপক্ষের সংশ্লিষ্টজনের কৃষি-সংবেদনশীল কর্মসূচির ফলে। কিন্তু তারপরও প্রতিনিয়ত দেশের কৃষিখাত বারবার নানা সংকটে পড়ছে।
কৃষিজমি সুরক্ষা, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ, জৈবকৃষি বনাম রাসায়নিক কৃষি, কৃষিতে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ, অপ্রতুল ভতুর্কি, কৃষিপণ্যের বাজার ও নিরাপদ খাদ্য, জেন্ডারবৈষম্য, দুর্যোগজনিত কারণে ফলন বিপর্যয় এবং জলবায়ুজনিত প্রভাব মোকাবিলার মতো সংকটগুলো সামাল দিয়েই প্রতিদিন মাথা তুলে দাঁড়ায় বাংলাদেশের কৃষি। তাহলে বাংলাদেশের কৃষির চলমান সংকট কী? গত কয়েকবছর ধরে ধান ও চালের ন্যায্যমূল্য বিতর্ক এক্ষেত্রে এক প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষিকাজে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ কমছে, পাশাপাশি রোপণ ও সংগ্রহ মওসুমে তৈরি হচ্ছে নিদারুণ শ্রমিক সংকট। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য এবং উৎপাদনে জড়িত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া দেশের কৃষিক্ষেত্রের সংকটকে জটিল করে তুলছে। এই সংকট সুরাহা হওয়া জরুরি।
এ দেশের কৃষিধারা মূলত গ্রামজনপদের পরিবারনির্ভর। এক একটি গ্রামে, এক একটি জনপদে এখানে ভিন্ন ভিন্ন কৃষিধারা আছে। কৃষিজমির ধরণ ও স্থানীয় বাস্তুসংস্থান, গ্রামীণ জীবন, শস্যফসলের বৈচিত্র্য, জনসংস্কৃতি সবকিছ্ ুমিলেই আমাদের নানা অঞ্চলের নানাধারার কৃষি। আর বৈচিত্র্যময় কৃষিজীবনের সম্ভার নিয়েই দেশের কৃষিজগত। বাংলাদেশে কৃষির উৎকর্ষের বিষয়ে অনেকেই সমন্বিত কৃষির কথা বলেন। বাংলাদেশের টেকসই কৃষির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশেষজ্ঞরা সবসময় প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে কৃষিসংশ্লিষ্ট নীতি, আইন, প্রজ্ঞাপন এবং অধ্যাদেশের কমতি নেই। জাতীয় কৃষিনীতি ১৯৯৯, জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৩ এবং সর্বশেষ জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ বিশ্লেষণ করে ধানসহ সকল কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষিতে চলমান শ্রমিক সংকট প্রশ্নের উত্তর মেলে না। যখন কৃষক উৎপাদনের চেয়েও কম দামে তার উৎপাদন বিক্রি করতে পারেন না, কোনো ন্যায্য বাজার পান না এবং যখন কৃষিমওসুমে তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয় তখন পাবলিক মিডিয়াতে এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলে। পাবলিক পরিসরে কিছুটা সাড়া তৈরি হয়। নগণ্যমাত্রায় হলেও কিছু মানুষ নানাভাবে কৃষি ও কৃষকের পাশে দাঁড়ায়। উৎপাদিত ফসল রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ জানায় বা কৃষকের জমিতে ধান কাটতে এগিয়ে আসেন অনেক সংবেদনশীল অকৃষক নাগরিক। কিন্তু ধানসহ কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি হয় না। এমনকি নতুনভাবে তৈরি হওয়া কৃষিতে চলমান শ্রমিক সংকট সমস্যার সুরাহা হয়ে যায় না। তাই আমরা দেখি আজও ধান মওসুমে কৃষকের চোখে পানি। ন্যায্য দাম না পেয়ে রাস্তায় আলু, টমেটো, ডিম, দুধ, রসুন ফেলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কৃষক। এই সংকট সমাধান হয়তো কোনোভাবেই এক দুইদিনে বা এক দুই কৃষি মওসুমে করা হয়তো সম্ভব নয়। এমনকি এটি শুধুমাত্র উৎপাদক ও ক্রেতা-ভোক্তা-বিক্রেতার আন্তঃসম্পর্কের তর্ক নয়। এই সংকটকে কৃষির সামগ্রিক সংকটের ভেতর দিয়েই বিশ্লেষণ করতে হবে। এই সংকট কোনোভাবেই এমনি এমনি তৈরি হয়নি। সামগ্রিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চলমান মিথষ্ক্রিয়ার ভেতরেই এই সংকট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সমাধান ঘটছে না।
তাহলে কি এভাবেই দেশের কৃষির চেহারা বদলে যেতে বাধ্য হবে? কৃষি কী আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে? আমরা কোনোভাবেই আমাদের কৃষিকে এমন জটিল সংকটের ভেতর পড়তে দিতে পারি না। এর দায় ও দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমাদের শিরা ও ধমনীতে কৃষিসংস্কৃতির রক্তপ্রবাহ। ধানসহ সকল কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ ও চলমান কৃষি সংকট মোকাবেলায় আমাদের করণীয়সমূহ নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই। জনেজনে প্রতিজনে সকলের পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো জানতে বুঝতে চাই। সরকারের কাছে কৃষি সংকট মোকাবেলায় এইসব জনপ্রশ্ন ও প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সর্বজনের সামগ্রিক তৎপরতার ভেতর দিয়েই আমাদের কৃষির চলমান সংকট নিরসন সম্ভব। আমাদের কৃষি আমাদের সকলের প্রাণের কৃষি হিসেবেই বিকশিত ও বিস্তৃত হোক এই আমাদের প্রত্যাশা।
ধানসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য ও কৃষির চলমান সংকট নিরসনে আমাদের বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনাসমূহ
উৎপাদন ও কার্যকর অংশগ্রহণ
১. দেশের সকল অঞ্চলের সকল নারী ও পুরুষ কৃষকের জন্য কৃষিকার্ড ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিশ্চিত করতে হবে।
২. কৃষকের জন্য সহজ, বিনাসুদ ও বিনাশর্তে কৃষিঋণ ও ভতুর্কি ও বিশেষ প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. কৃষিজমির অকৃষিখাতে ব্যবহার সামগ্রিকভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
৪. উৎপাদন থেকে কৃষিপণ্য ব্যবহার অবধি সকল স্তর ও পর্যায় ক্ষতিকর রাসায়নিক দূষণ, শ্রমশোষণ ও ন্যূনতম বৈষম্য দূর করে কৃষিকে দেশের কৃষক পরিবারের পারিবারিক কৃষিঐতিহ্য হিসেবে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
৫. কৃষিপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্যের আর্দ্রতা, রাসায়নিকের উপস্থিতিসহ পণ্যের মানযাচাইয়ের নামে কৃষক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। মানযাচাইসহ পণ্যের বাজার উপযোগিতার বিষয়গুলো চাষের পূর্বেই কৃষককে সরকারিভাবে অবহিত করতে হবে।
মজুতকরণ ও সংরক্ষণ
৬. দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে এমনকি ক্ষেত্রভেদে কৃষক ও স্থানীয় পর্যায়ে ধানসহ কৃষিপণ্য মজুতকরণের শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
বিপণন ও প্রবেশাধিকার
৭. প্রতি কৃষি মওসুমের শুরুতেই কৃষিপ্রতিবেশ, কৃষকের সামাজিক পরিস্থিতি, ক্রেতা-ভোক্তার চাহিদা এবং চলমান জীবনযাত্রাকে বিবেচনা করে মওসুমভিত্তিক ধানসহ কৃষিপণ্যের একটি সুনির্দিষ্ট মূল্যতালিকা নির্ধারণ করতে হবে।
৮. সরকারি মূল্যে ধানসহ কৃষিপণ্য সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য একটি সক্রিয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষকের নিজস্ব কৃষিকার্ড (পরিবারের সদস্যসহ) এবং জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার আইডি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিজন কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের সীমা বাড়াতে হবে (কৃষক যত পরিমাণ ধান বিক্রি করতে চান)। সরকারিভাবে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও কৃষক লক্ষ্যমাত্রা বাড়াতে হবে।
৯. কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ফড়িয়া, মহাজন, দালাল, মধ্যস্বত্বভোগীদের খবরদারি বন্ধ করতে হবে।
বহুমুখীকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
১০. ধানসহ কৃষিপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ধান থেকে বিবিধ খাদ্যপণ্য তৈরি এবং গম-যব-ভূট্টাসহ দানাশস্য থেকে উৎপাদিত পণ্য উৎপাদনে চাল ব্যবহার করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে।
১১. বিশেষ পরিস্থিতি ও দুর্যোগকালিন সময়ে শহর ও গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষের জন্য স্বল্পমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি ও সরবরাহ করে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে সরকারিভাবে কৃষক থেকে ক্রয়কৃত ধানসহ কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১২. কৃষিতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ বাড়াতে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষির উৎপাদন, মজুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন ও বহুমুখীকরণের নানা স্তরে নানাভাবে তরুণদের তাদের আগ্রহ, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার নিরিখে যুক্ত করতে বিশেষ প্রণোদনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৩. গ্রামীণ দারিদ্র্যের স্বরূপ সন্ধান ও বিশ্লেষণ করে দেশের প্রতিটি এলাকায় আয়বৈষম্য, কর্মহীনতা, কর্মসংস্থানের অভাব, কৃষি পেশার মর্যাদাহীনতাকে বিশ্লেষণ করে দেশের প্রতিটি এলাকার নারী, ভূমিহীন, আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিক কৃষকদের আরো কার্যকরভাবে কৃষির নানামুখী ক্ষেত্রে যুক্তকরণের কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
তথ্যপ্রবাহ ও জবাবদিহিতা
১৪. কৃষির সাথে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে জড়িত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং কর্মসূচি সমূহের তথ্য নিয়মিত পাবলিক করা জরুরি এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা আরো দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধকরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। দেশের প্রতিটি প্রান্তে কত দামে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এবং প্রতিটি মওসুমে কী ধরণের কৃষিপণ্য কতটুকু উৎপাদন ও মজুত হয়েছে এবং ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে এসবের সামগ্রিক তথ্য সরকারিভাবে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্রে হালনাগাদ থাকতে হবে।
১৫. ধানসহ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে স্থানীয় পর্যায়ে ইউনিয়ন ভিত্তিক কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটিতে স্থানীয় সরকার সদস্য, কৃষক প্রতিনিধি, নারী কৃষক, আদিবাসী প্রতিনিধি, যুব প্রতিনিধি, দূর্যোগ কমিটির সদস্য, বাজার কমিটির সদস্য, প্রশাসনের সদস্য, মানবাধিকার সংগঠক, সাংবাদিক প্রতিনিধির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।