এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি ,সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সুকান্ত সেন, সম্পাদক, বারসিক নিউজ ডট কম
বৈচিত্র্যময় শস্য ফুলে ফলে ভরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। নদী-নালা-খাল-বিল-বন-জঙ্গলে ঘেরা এদেশেই আছে পশু-পাখি, শস্য ফসল আর মানুষের প্রাণের এক নিবিড় সম্পর্ক। ঋতুভিত্তিক বৈচিত্র্যময়তা এই সম্পর্ককে আরও মধুময় করে তোলে। মানুুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক কত যে আত্মিক তা বুঝা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অরাজনৈতিক দুর্ঘটনার সময়। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘুর্ণিঝড় সিডর বা আইলার মত দুর্যোগে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষই ছুটে গিয়েছিল আগে, যার যতটুকু সামর্থ আছে তা নিয়েই। সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের পর পর আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারের আহ্বানের অপেক্ষায় থাকেনি কেউ। মানুষ প্রাণের টানে উদ্ধারে ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য ও ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের সাথে মাসব্যাপী উদ্ধারে যুক্ত ছিল। শহরের যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা সবসময় বিবৃতির ভাষায় নষ্ট সময়ের যাত্রী, সব কিছুকেই মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। দলীয় রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ না থাকলেও মানুষকে ভালোবাসা, মানুষের প্রতি দায়, মানুষের বিপদে ঝাপিয়ে পড়া নেশার মতো প্রতিটি বাঙালি-আদিবাসীর ধমনিতে প্রবাহিত। কিশোর জাহাঙ্গীর, ইনজেকশন দেয়ার শিক্ষা ছিল না তার কোনদিন, ছিল না কোন অপারেশন করার দীক্ষাও। সবকিছুই সম্ভব করে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে ইট কংক্রিটের ভেতর থেকে জীবিত উদ্ধার করেছেন অনেক গার্মেন্টস কর্মীকে। সংস্কৃতিকর্মী আসমা আক্তার লিজাকে মনে হয়েছিল তার পরিবার পরিজন সবাই আটকা পড়েছে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে। উদ্ধারকালীন সময়ের প্রতিদিনের প্রতিটি মুহুর্ত ব্যয় করেছেন শ্রমিকদের জীবিত উদ্ধারে। কেউ কাউকে ডাকেনি। প্রাণের ডাকে, জীবনের আহ্বানে সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে ঝাপিয়ে পড়ে। এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়, দুর্যোগ, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, রাস্তাঘাট-স্কুল-মাদ্রাসা সংস্কার, উন্নয়ন সব ক্ষেত্রেই ছিল মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস। বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের, এক এলাকার সাথে অপর এলাকার আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। এই আত্মীয়তার বন্ধনের সাথে যুক্ত থাকে নিজ জমিনে জন্মানো শীতকালের বাহারি শীম, লাউ বা শীতের সকালে গরম গরম ভাত খাবারের ধান। এভাবেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বাইরে নতুন এক শস্য বন্ধন তৈরি হয়, যা গাণিতিক হিসাবে পরিমাপ করা কঠিন। মানিকগঞ্জের রাশেদা বেগম, পিরোজপুরে সঞ্জিতা রাণীর বাড়িতে বেড়াতে এসে বয়ে নিয়ে যান সুস্বাদু ও তাঁর দেখা নতুন “কামরঙ্গা শীমের বীজ”। দেখে যান কিভাবে শুধু বাড়ির ফেলে দেয়া পাতা কুটা আর গোবর পচিয়ে জৈব সার তৈরি করেন। পরের শীতে রাশেদা বেগমের পালানে শোভা পায় আগের বারের বয়ে নিয়ে আসা কামরঙ্গা শীম। রাশেদা বেগমের নতুন করে দরকার হয়নি কোন শীম লাগানো বা জৈব সার তৈরির প্রশিক্ষণ। ভালোবাসার বন্ধন, সবাই মিলে ভালো থাকার প্রতি মুহূর্তের এ চেষ্টা জীবন-জীবিকার অংশ হিসেবে এখনও বহমান। এভাবেই বাংলাদেশের গ্রাম-শহরের এক মানুষের সাথে আরেক মানুষের, এক এলাকায় সাথে অপর এলাকার আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। ভালোবাসার বন্ধন জীবনের অংশ হিসেবে এখনও টিকে আছে।
গ্রামের রাস্তাঘাটের সংস্কার, খাল-বিলের উপর বাঁশের সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার কোন কিছুর জন্যই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য অপেক্ষায় থাকেনি। নওগাঁর পলান সরকার এই বৃদ্ধ বয়সেও বই পড়ার অভ্যাস বাড়ানোর জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান। সাতক্ষীরা শ্যামনগরের মোটর সাইকেল চালক জাকির হোসেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেই রাস্তার পাশে খালি জায়গায় বৃক্ষ রোপণ করেন। এলাকাবাসীর কাছে যিনি বৃক্ষ প্রেমিক জাকির নামে অভিহিত হয়েছেন। এভাবেই বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জের একজন আরেকজনের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকেই তার জীবনধারণ, জীবিকার উন্নয়ন, সামাজিক চেতনা শক্তিশালি করার ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতার এক সৃদৃঢ় কাঠামো তৈরি করেছেন। অগ্রগতি মানেই শুধু অর্থনির্ভর কোন কিছু নয়, নিজের জমিনে আউশ ধানের পোকা কিভাবে দমিত হয়েছে, অন্যদের মাঝে তা পরিষ্কার করাও এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ারই অংশ। এজন্যই হয়তো সাতক্ষীরার কৃষাণী ফরিদা পারভীন ও জাহাঙ্গীর অলম সাতক্ষীরার গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ান, নিজেদের সফলতার গল্প বলেন আর সাথে থাকা দেশীয় শস্য ফসলের বীজ সম্পর্কের সূচনা হিসেবে বিলি করেন।
ধীরে ধীরে গ্রামের একজন সাধারণ নারী, অসাধারণ প্রতীকে পরিণত হয়ে পড়েন আর ফরিদা পারভীন-জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ি পরিণত হয়ে পড়ে প্রায়োগিক শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে সাতক্ষীরাসহ আশেপাশের অনেক উদ্যোগী নারী-পুরুষের। ২০১৪ সালে লাভ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক”। শ্যামনগরের হায়বাতপুরের একজন ফরিদা পারভীন জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়ে যান তাঁর বাড়ির প্রতি ইঞ্চি জায়গার স্থায়িত্বশীল ব্যবহারে। এমন করেই শ্যামনগরের আরেক নারী আল্পনা মিস্ত্রির কৃষি জীবন ঘুচিয়ে দেয় তাঁর পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা, এনে দেয় পরিবার ও সমাজে একজন সম্মানের আসনে। নারী বা আর্থিক অর্থে দরিদ্র কোন পরিচয়ই থেমে থাকেনি “উপজেলা জয়িতা পদক”, “সাতক্ষীরা জেলা জয়িতা পদক”, “খুলনা বিভাগীয় জয়িতা পদক” এবং সর্বোপরি ১৩ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করা “বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক” প্রাপ্তিতে। এই শ্যামনগরের হায়বাতপুরেরই অগ্রগামী কৃষক ও শ্যামনগর জনসংগঠনের আহবায়ক সিরাজুল ইসলামও লাভ করেন “চ্যানেল আই কৃষি পদক”। একই বছর একই এলাকা থেকে এরকম জাতীয় পদক লাভের বিরল সম্মান কখনো হয়নি আগে।
জীবন জীবনের জন্য
প্রকৃতিতে বৃক্ষ-গুল্ম-লতা-পাতা-শস্য-ফসল ছাড়া আর কোন জীবের নিজের খাদ্য নিজে উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই। এই উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশে মানুষ সত্যিকার অর্থেই একজন প্রতিবন্ধী। মানুষ জীবজগত-আলো-মাটি বাতাস-পানি নিয়ে গঠিত এই বিশাল খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র এবং একে অন্যের উপর কোন না কোনভাবেই নির্ভরশীল। প্রকৃতির এই পারষ্পরিক নির্ভরতাকে সক্রিয় রাখা এবং সবার সামর্থ্য-সক্ষমতাকে বিশ্বাস করে নিজস্ব জ্ঞান ও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার আলোকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার দৃশ্যমান ক্ষমতা শুধু মানুষেরই আছে। ফলে ‘মানুষ’ হিসেবে তার দায়িত্বও অনেক। প্রকৃতি যার যা অবস্থা, অবস্থান ও প্রয়োজন তা মাথায় রেখেই একে অপরের সম্পর্কের যাত্রা শুরু করেছে শত সহ¯্র্র বছর আগেই। গড়ে তুলেছে এক বন্ধুরতার সম্পর্ক। ফলে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ, বাঘ-হরিণ, বানর, সাপ, পাখি, মৌমাছি কিংবা সুন্দরবনের ভেতর প্রবাহমান খালে পারশে, দাঁতিনা, তপসে মাছের জন্য বনবিভাগ কিংবা মৎস্য বিভাগ বা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে খাবার সরবরাহে কোন অগ্রীম বাজেট বরাদ্দ রাখার দরকার পড়েনি। গাছপালা বা বন্য প্রাণীর জন্য খাবার নিয়ে রাষ্ট্রকে কিংবা বন বিভাগকে ভাবতেও হয়নি কখনও। পদ্মার ইলিশ বা দেশের বৃহত্তম হাওর-বাওরের মৎস্য সম্পদ, দেশীয় পাখি বা শীতকালীন অতিথি পাখির খাবারের চিন্তায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেশ-বিদেশে “স্থায়িত্বশীল খাবার নিশ্চিতকরণ প্রকল্প” নিয়ে ঘুরতে হয়নি, যেভাবে বাজে বরাদ্দ করতে হয় চিড়িয়াখানার জন্য। প্রকৃতির খাদ্যচক্র আর প্রকৃতির চলমান বিজ্ঞানই শত সহ¯্র জীবকে নিশ্চিত করেছে বছরের পর বছর। অর্ধাহারে-অনাহারে কোন জীবকেই মরতে হয়নি। বিঘœ তৈরি হয়েছে তখন থেকেই যখন আমরা ‘মানুষ’ নিজ বা ‘প্রতিষ্ঠানের নামে’ নিজকে অসীম ক্ষমতাধর ভেবে সীমাহীন দায়িত্ব নিয়েছি ।
মধুপুরের শালবন নিজ নাম আর গুণেই সবার কাছে পরিচিত ছিল। শুধু তো শালই ছিল না শালবনে। মধুপুর এলাকায় ২০০৬ সনে বারসিকের এক গবেষণাকালীন সময়ে মধুপুরের পীরগাছা ক্যাথলিক মিশনের পুরোহিত ফাদার ইউজিন হোমরিক উল্লেখ করেছিলেন যে, “৫০ বছর আগে যখন আমি এখানে আসি, তখন এখানে প্রায় ৬০ প্রকারের গাছ, ৩০০ প্রকারের পশুপাখি ছিল। বনের ভিতরে গেলে সুখ শান্তি পেতাম। বিশ্বব্যাংক প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে উন্নয়নের নামে বন বাগান তৈরি করে মধুপুর বনের প্রায় ৬০ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস করেছে।” মধুপুর শালবন রাবার বাগান, আগ্রাসী ইউক্যালিপটাস, কলাবাগান আর আনারস বাগানে পরিণত হয়েছে গত কয়েক দশক ধরে। মধুপুরের মত এরকমই মানুষের ক্ষমতা ও লোভের কাছে পরাজিত হয়েছে সুন্দরবনসহ অনেক বনভূমি। সামুদ্রিক জলোচ্ছাস থেকে রক্ষালাভে উপকূলে বেড়ে উঠা ঝাউ গাছ বন কেটে ইটভাটা বানানো, সাময়িকভাবে কোন ব্যক্তি উপকৃত হলেও রক্ষা করা যায়নি একের অধিক অনেক পরিবারের স্থায়ী সম্পদ কাঠামো।
বন মানেই জীবজন্তু, পোকামাকড়, পশু-পাখি, গাছ-গাছরা ও মানুষসহ অসংখ্য প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে গঠিত এক সমন্বিত ক্ষেত্র। যে কোন একটি আক্রান্ত হলেই অপরটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠিক তেমনি খাল-বিল-নদী-নালা মানে মাছসহ জলজ প্রাণ ও মানুষের সমাহার। নদীর পানি বাঁচলে বাঁচে মাছ ও জলজ প্রাণ, মাছ বাঁচলে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে জেলে সম্প্রদায় আর প্রাকৃতিক মাছ বাঁচলে রক্ষা পায় জনপুষ্টি। মাছ অন্যান্য জলজ প্রাণের উপর নির্ভরশীল। আর জলজপ্রাণ না থাকলে পানি দূষণের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। পানি-প্রাণী সবই মৃত্যুর সাথে লড়াই করে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে। সীমাহীন লাভের আশায় এই বিশাল প্রাণচক্র ছিনতাই করে নিজের হাতে তুলে নেয়ার আগে মানুষ হয়তো ভাবতেই পারেনি কি হতে পারে ভবিষ্যতে! কোন্ পাখি কোন্ গাছের ডালে থাকতে পছন্দ করে, কোন্ গাছ তার পাশের কোন্ গাছের সাথে একসাথে থাকতে পছন্দ করে; কোন মাছ জলজ প্রাণী বা কোন পোকাকে খেতে পছন্দ করে। ঝড়-বৃষ্টি হলে বনের বাঘ বা অজগর কোথায় কিভাবে কোন গাছের ছায়ায় থাকতে চায়, কে কিভাবে কতদিনে বুঝবে। বুঝতে বুঝতেই তো এক জনম শেষ। শুধু পরিবারের এক ছোট বাচ্চার আসলে কি পছন্দ, কি রঙ পছন্দ, কোন খাবার খেতে ভালোবাসে, কোন সময় খেতে ভালোবাসে পরিবারের মা-বাবাসহ প্রায় সকল সদস্যের শুধু এটি জানতেই শিশুটির ছোটবেলা গড়িয়ে কিশোরকালে পরিণত হয়। ফলে মানুষ এ বিশাল দায়িত্ব সীমাহীন লোভের কাছে হস্তান্তরের ফলে সুন্দরবনের সব সুন্দরী গাছকে প্রতি মূহুর্তে ঘরের আসবাবপত্র বানানোর উপকরণ ভাবে। হরিণকে ভাবে গো-শালার সব গবাদিপশুকে বিক্রি করে দিয়ে হরিণের খামার বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। বাঘের চামড়া দিয়ে ঘরে প্রবেশের আগে পা মুছতে চায় আর বাঘকে পরাজিত করে নিজে সর্বোচ্চ শক্তিমানে পরিণত হতে চায়। শক্তিমান হওয়ার স¦প্নে প্রতি মুহূর্তেই এক অস্থির চিত্তের দানবে রূপ নেয়। সব নদীর পানি, মাছ, বনের প্রাণী, অতিথি পাখিসহ সব সব পাখি খেয়ে ফেলতে চায় একবারে পারলে শুধু নাস্তার টেবিলে বসেই। পাশের সবাইকে শত্রু মনে হয়, এভাবে ‘মানুষ’ অজ্ঞাতসারে নিজেই পরিণত হয়ে যায় পরিবার-সমাজ কিংবা নিজ থেকেই বিচ্ছিন্ন এক “হায়েনায়”। প্রাণী বা প্রাণীর আশ্রয়স্থল গাছ উজাড় করে, নদী বা জলাশয়ের ডিমওয়ালা মাছ ধরে, পাখি হত্যা করে মানবশিশুর সুন্দর “শিশু বা কিশোরকালকে চুরি” করার মতই আমাদের লোভ আর লালসা মিলে লুট করে ফেলি কত সহশ্র নাম না জানা বন্য প্রাণী-পাখির শৈশব বা কিশোরকাল। “সৃষ্টির সেরা জীব” হিসেবে আমাদের এই পাপের শেষ কোথায় ?
কিন্ত প্রকৃতি “আইনের চোখে সবাই সমান” এর মতো সবার প্রতি সমান মর্যাদা সমান দায়িত্ব পালন করে থাকে। প্রকৃতির ভাষা বুঝার অজ্ঞতার কারণে প্রকৃতি থেকে, প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে “প্যাকেজেই সমাধান” হিসেবে জীবনের মূলমন্ত্র বেছে নেই কেউ কেউ। নিজেও নিজের প্রতি নির্ভরশীল নয়; নিজকেও প্রতি মূহূর্তে নিজের কাছে এক অজানা জীবে পরিণত করে। কিন্ত প্রাণের টান বুঝার কারণেই, প্রাণের প্রতি বিশ্বাসের কারণে রাজশাহীর তানোরের ৭০ বছর বয়সী তরুণ (যিনি নিজেকে তরুণ ভাবতেই ভালোবাসেন) ইউসুফ মোল্লা এলাকাবাসীকে স্থানীয় নানান জাতের সুগন্ধী ধানের আবাদে উৎসাহ যোগান। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়ান যদি কোন হারানো ধানের জাত সংগ্রহ করা যায়! নিজের জায়গা দান করে কষ্টে অর্জিত অর্থে গড়ে তুলেন “ধান যাদুঘর, এক শিক্ষা কেন্দ্র”। এই অস্থির সময়ে যখন অনেকেই অন্যের জমি-সম্পদ-বন-নদী-নালাকে নিজের (ক্রয়সূত্রে!) নামে ভাবতেই স্বাচ্ছন্দ মনে করে, তখন এরকম একজন ইউসুফ মোল্লা, নওগাঁর মহাদেবপুরের একজন গঁহের আলী ভিক্ষা করে রাস্তার পাশে তাল গাছ লাগান, নাটোরের একজন যষোধন প্রামাণিক “পশু-পাখিকূলের নিরাপদ বাসস্থান আর খাদ্যের নিশ্চয়তার” লক্ষ্যকে জীবনের ব্রত ভাবেন। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার বদলাবাড়ি গ্রামের প্রবীণ কৃষক নূরুজ্জামান মন্ডল এখনও এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছুটে যান অন্যান্য কৃষকদের সহায়তার জন্য। গবেষণা করছেন কিভাবে স্থানীয় প্রতিবেশ-পরিবেশ উপযোগি ধান জাত উদ্ভাবন করা যায় এবং প্রায় ২টি নতুন ধান জাত উদ্ভাবনের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ের মাঠ গবেষণা করছেন।
‘দশে মিলে করি কাজ’-এর শিক্ষাকে বুকে ধারণ করে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও বরগুণার পাথরঘাটা উপজেলার প্রায় শতাধিক কৃষক পরিবার মিলে পাথরঘাটার রায়হানপুরে গড়ে তুলেছেন “উপকূলীয় বীজ ব্যাংক”। গাইবান্ধার ফুলছড়ির কালাসোনা চরের কৃষক পরিবাররা মিলে প্রতিষ্ঠা করেছে “চর বীজ ব্যাংক”, যাতে ভবিষ্যতে কোন বীজ এলাকার কোন কৃষি পরিবারকে কিনতে না হয়। বীজব্যাংক শুধু বীজ বিনিময়ের কেন্দ্র নয়, কৃষকের যৌথ গবেষণা, অভিজ্ঞতা ও কারিগরি জ্ঞান বিনিময়ের এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও সম্মিলিতভাবে জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা করা। চারিদিকে পানি আর পানি, সুনামগঞ্জের মধ্যমগ্রামের হাওরের মাঝে এমন একটি ছোট জায়গা নিয়ে ‘নীলিমা সরকারের ভাটি বাড়ি” এলাকার কৃষক, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ অনেকের কাছে বিস্ময়ের জায়গা, কিভাবে সম্ভব এই পরিবর্তিত পরিবেশে একটি ছোট বাড়ি এর ছোট উঠানকে ভর করে টিকে জীবনের নিশ্চয়তা করেছেন।
এভাবেই নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আর প্রায়োগিক কৌশল সহায়তায় উপকূলীয় এলাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে নেত্রকোনার হাওর পাড়ের মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। মানিকগঞ্জে চরে ডালসহ মিশ্র ফসলের চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে যায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি চর থেকে আসা কৃষক-কৃষাণী পরিবার। নেত্রকোনার হাওয়া বেগম এলাকার নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে উঠার জন্য পাশ্ববর্তী গ্রামের নারীদের দাওয়াত দিয়ে শিখান কিভাবে বাঁশ-বেত দিয়ে নারীরা ঘরে বসেই কৃষিকাজ বা গৃহস্থালির ব্যবহার্য জিনিসপত্র তৈরি করে আয় করা যায়। জেলে-কৃষক-দিনমজুর মিলে নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেন এক সমন্বিত উদ্যোগ, কেউ একা নয়, আমরা সবাই সবার জন্য। চাঁপাইনবানগঞ্জের নাচোল উপজেলার বরেন্দ্রা গ্রামের শুতিকার দিঘি হয়ে এখনও গ্রামের “সম্প্রীতির উজ্জল দৃষ্টান্ত” হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। দিঘির আয় থেকে সবাই মিলে এলাকার রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। পারিবারিক ও সামাজিক আপদে-বিপদেও দিঘির আয় থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে সাময়িকভাবে সমাধান করেন। বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক আর একজন কৃষক যৌথভাবে শুরু করেন প্রায়োগিক গবেষণা সমমর্যাদার সহযোগী হিসেবে। নেত্রকোনার আটপাড়ার সৈয়দ আহমেদ বাচ্চু, যোগেশ দাস, ফৌজিয়া নাসরীন স্কুলের ক্লাশের অবসরে শিক্ষার্থীদের সাথে জীবনের গল্প, পরিবর্তনের গল্প বলেন আর বিস্ময় আন্তরিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা মন্ত্র মুগ্ধের মত করে শুনেন ।
শ্যামনগরের শিক্ষার্থী মিলন তার বন্ধুদের সম্মিলিত উদ্যোগে সাহস ফিরে পায় চিংড়াখালি গ্রামের খাবার পানির কষ্টে থাকা শত পরিবারকে পানি সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য সহযোগিতা করার! একজন গবেষক শাহীন ইসলামের রক্তে সুস্থ হয়ে উঠে একজন অপরিচিত প্রসূতি মা, যিনি হয়তো শাহীন ইসলামকে কখনও দেখেননি। রাজশাহী তানোর উপজেলার মোহর গ্রামের ‘স্বপ্ন আশার আলো যুব সংঘ’র যুবকরা মোহর গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার শপথ নিলে এলাকার সবার মাঝে তা সাড়া পড়ে, উদ্বুদ্ধও হয় অনেকে। ময়মনসিংহের কৃষক-প্রকৌশলী কেনু মিস্ত্রির কৃষি যন্ত্রপাতি আবিস্কার ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ অনেক কৃষকের কাজকে সহজ করে দেয়। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের কৃষি উপকরণ যাদুঘরে কেনু মিস্ত্রির আবিষ্কৃত উপকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গবেষকদের কাছে নতুন গবেষণার দ্বার উম্মোচন করে দেয়। সরকারি-বেসরকারি টাকায় প্রতিষ্ঠার পর নিজের বা প্রিয়জনের নামে নামকরণ বাংলাদেশের এক অলিখিত রীতি গত কয়েক দশকের। নিজেদের অর্থে অন্যের জন্য কল্যাণময় অনেক উদ্যোগ অনেক সময় হারিয়ে যায়। তারপরও উদাহরণ তো আছেই। বাংলাদেশের কন্ঠশিল্পী রাজনীতিবিদ সাংসদ মমতাজ বেগম নিজের অর্থেই সম্প্রতি সিঙ্গাইরে এলাকার গাজর চাষীদের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠা করেছেন গাজর সংরক্ষণাগার (মধু উজালা কোল্ড স্টোরেজ লি.)। সিঙ্গাইর বাংলাদেশের অন্যতম গাজর উৎপাদন অঞ্চল এবং এলাকায় সংরক্ষণাগারের অভাবে অনেক গাজর নষ্ট হয়ে যেত। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হলেও এরকম স্থানীয় চাহিদা ও এলাকাভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠানই তোলা সম্ভব ছিল বাংলাদেশের অনেকের পক্ষেই অনেক যায়গায়।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ
আর এই কাজটিই অবলীলায় জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে করে যাচ্ছি আমরা প্রতিদিন। মানুষের ভেতরে অর্ন্তনিহিত শক্তি দীর্ঘদিনের অর্জিত জ্ঞান, খরা-বন্যা-জলোচ্ছাসে লড়াই করে টিকে থাকার অভিজ্ঞতা, রসহীন শক্ত মাটিতে সোনায় ফসল ফলানো, অপরিচিত জনকে মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার অসম্ভব দক্ষতা সবই আমরা আমাদের বইয়ের ভাষায়, কখনও তাত্ত্বিক ভাষায় কঠিন করে উচ্চারণ করে মানুষের কাছে কঠিন করে তুলে ধরি। শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনি ব্যারাকের কৌশলা মুন্ডারা কিভাবে ব্যারাকে তপ্ত বালুকে উর্বর ভূমিতে পরিণত করল, তার উত্তর জানার চেয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে “এবার এখানেও ঋণ দেয়া যাবে, সামর্থ বেড়েছে পরিশোধ করার”। অথচ কৌশলা মুন্ডারা শুধু ঋণ চায়নি, চেয়েছিল ব্যারাকের তপ্ত ভূমিকে একটু শীতল আবাস ভূমিতে রূপান্তরিত করার। তাঁর নিজের জ্ঞান, নিজের চেনা জগৎ মুহুর্তেই মনে হয় এক ঘোর অমানিশায় হাবুডুবু খেয়ে বেড়ায়। আমরা শুনতেও চাই না তাঁর মত, তাঁর নিজস্ব যুক্তি, বরঞ্চ নিজের মত বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত তুলে ধরি, ‘আমরাই সঠিক’ এবং ‘শতকরা একশত ভাগ সঠিক’। কিন্তু কোনটা সঠিক, কার জন্য সঠিক, কখন সঠিক সেই প্রশ্ন করি না নিজেকে কখনও। কারণ তাঁর মতামত না জেনে নিজেকে এক সবজান্তা ও হাল সময়ের প্যাকেজ সমাধান ভাবার এক তান্ত্রিক যাদুকরের কৃতিত্ব জাহির করি। ষাটের দশকে সাতক্ষীরা সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় অধিক ফসল উৎপাদন জন্য ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাস প্রতিরোধের জন্য উপকূলীয় বাঁধ তৈরি হয়। উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশে মানুষ জোয়ার ভাটায় স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রেখেই উন্নয়ন করা যায় বলে পরামর্শ দেন। সে ধরনের কোন পরামর্শই তৎকালীন রাষ্ট্রীয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী টিম ও তাদের বিদেশি পরামর্শকরা গ্রহণ করেনি। কারণ ওদের কাছে “সমস্যা তোমার, সিদ্ধান্ত আমার, কারণ টাকা আমার”। কিন্তু মাত্র ৩০-৪০ বছর পরে এসেই প্রমাণিত হয়েছে মিষ্টি পানি প্রবাহিত সকল নদ-নদীর গতিপথ প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। নদীর মোহনা প্রায় পলি জমে বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আবার প্রকল্প খুলনা-যশোর পয়ঃনিঙ্কাশন প্রকল্প। সবশেষে সব প্রকল্পই জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে দেয়। লবণাক্ততার বিষে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মাটিকে বিশাক্ত করে তুলে। ২০০০ সালের পর এসে “সাধারণ মানুষের অসাধারণ অভিজ্ঞতানির্ভর জ্ঞানকে” সঠিক হিসেবে মনে করেন পরিকল্পনাবিদরা, তাও প্রায় ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর! কিন্তÍ ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই নতুন করে আবার জোয়ার-ভাটা খেলা শুরু করার প্রকল্প, যা ছিল শত বছর ধরে। এমনি করেই এভাবেই মানুষের শত শত বছর ধরে অর্জিত লোকায়ত জ্ঞান বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা হয়, পরপস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা প্রতিষ্ঠা পায় জোরেসোরে। কারণ জ্ঞানকে স্বীকার করলে, জ্ঞানধারণকারী সাধারণ মানুষটিকেও অজ্ঞাতসরে স্বীকার করা হয়ে যায়। মানুষকে নিজের কাছে বিশ্বাসহীন গড়ে তোলার কি দারুণ অপচেষ্টা! কারণ প্রকল্প আছে, টাকা আছে বাস্তবায়ন করতেই হবে। হাওর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা জন্মের পর থেকেই জানতে শুরু করে বর্ষা মানেই চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আর অগ্রীম আফাল পাহাড়ি ঢল এলে তো পাকা ধান ঘরে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকৃতির বিজ্ঞানই হাওর এলাকাকে পূর্ণ করে দিয়েছে। হিজল-করচ-তমাল গাছের জীবন দিয়ে পানিতে বড় হয় এবং আফালসহ বর্ষাকালীন বড় বড় ঢেউ কবল থেকে হিজল করচই রক্ষা করে ভিটে বাড়ি, রাস্তাঘাট। পাহাড়ের ঢালে জন্মানো ঘাসহীন পাহাড়ি ঢলের গতির ধারাকে ধীর করে দিত, ফলে পাহাড়ি ঢল শুরু হলেও হাওর এলাকার দু’এক দিন সময় পেতো পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার। একদিক মেঘালয় পাহাড়ের কয়লা খনি আর হাওর এলাকার অপরিকল্পিত রাস্তা, অসংখ্য অসমাপ্ত উন্নয়ন কাঠামো আর প্রভাবশালী রাজনৈতিক মৎসজীবী (লিজ নেয় শুধু মাছ ধরাকালীন সময়ের জন্য) মিলে মিশে হাওর এলাকার মৎস সম্পদ, হিজল, করচ গাছ, মাছ সবটার মালিক বনে যায়।
এভাবেই হয়তো তারপরও মানুষ আপন বিশ্বাসে নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখেই সামনে এগিয়ে যায়। নিজেই নানামুখী কাজের সাথে যুক্ত রেখে পরিবার সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর মানুষের সক্ষমতাকে বিশ্বাস করতে না পারার, সম্মান করতে না জানায় মানুষ, সংগঠন, রাজনীতি রয়ে যায় পিছনে। সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় আন্তর্জাতিক গবেষণায় তা প্রতিফলিত হয় যে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষাদীক্ষায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই। কিন্তÍ পিছিয়ে পড়ছে রাজনীতি আর অপিরকল্পিত উন্নয়ন উদ্যোগ!
হাতের কলম জনম দুঃখি তাকে বেচনা
সবকিছুই বিক্রি করা যায় না। জীবন চলে, হয়তো চলে, আবার চলেও না। বাংলাদেশ গ্রাম শহরে প্রান্তিক মানুষগুলো, আমাদের চোখে যারা প্রতিবন্ধী, যারা শুধু দরিদ্রের নামে, দারিদ্রতার নামে পরিচিত, তারা বিক্রি হয়ে যায় তাঁদের অজান্তেই আমাদের মত শিক্ষিত মানুষের হাতের নানা দলিলে, ছবিতে, গানে, সিনেমায় কখনওবা অন্যের বিনোদনের জন্য আবার কখনও বা অর্থ বা জাতীয় আন্তর্জাতিক পুরস্কারের আশায়। বাংলাদেশের সন্তান সদ্য প্রয়াত মার্কিন প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম বাংলাদেশ এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের’ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ গবেষক দল এবং কম্পিউটার প্রতিষ্ঠান ডাটাসফটের সমন্বয়ে গড়ে তোলে এক স্বপ্নযাত্রা। সফলও হয় ২০১৩ সনে পাটের জীবন রহস্য উম্মোচনের। আমরা যখন অনেক সমালোচনামূখর হই রাষ্ট্রীয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে, তখন সেই রাষ্ট্রই প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিয়ে ও পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউট তাঁর সর্বোচ্চ শ্রম, আন্তরিকতা ও আবেগ দিয়েই এই কঠিন গবেষণাটি সফল করে তুলতে সহায়তা করে। গবেষণাকালীন অনেক তরুণ অনেক বেশি বেতনের চাকরির হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিমগ্ন থেকেছেন গবেষণার কাজে। সম্প্রতি পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার লেখায় জানা যায়, প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের জন্য সরকারি সহযোগিতায় পাট গবেষণার এই প্রকল্পের মাধ্যমে মাসে ষোল লক্ষ টাকা মাসিক সম্মানী ও বাংলাদেশ থাকাকালীন সময়ে তাঁর জন্য হোটেল সোনারগাঁও/শেরাটনের ব্যবস্থা থাকলেও তিনি কোন বেতন গ্রহণ করেননি। সুযোগ থাকার পরও বিলাসবহুল কোন হোটেলে এক রাতের জন্যেও থাকেননি। কিন্তু আমরা দেখেছি, বছরের পর বছর সরকারি-বেসরকারি-দেশি-বিদেশি অর্থ নানাভাবে খরচ করে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট-কান্নাকে পুঁজি করে নিজকে সম্মানিত করার, স্বপুরুষ্কৃত হবার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে প্রায় সব সময়ই দেশে দেশে।
প্রতূল বন্দোপাধ্যায়ের সেই সঙ্গীত যেন শুধু আমাদের জয়নাল আবেদীনদের মতো সেই স্বপ্নের সারথী থাকারই সাহস যোগায়, কষ্ট আবেগের বিক্রির ফেরিওয়ালা নয়। আমাদের সবার আলোকিত বাতিঘর প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখনও চির সবুজের মত আলোকিত মানুষ গড়ার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেন। গণমাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের খবর একটি খবরের মত বিষয় হতে পারে, তা তো দেখিয়ে দিয়েছেন এবং জনপ্রিয় করেছেন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব একজন শাইখ সিরাজ। এখন প্রায় প্রতিটি খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে “কৃষি খবর” একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে। ঝিনাইদহের কৃষক হরিপদ কাপালী প্রমাণ করেছেন, একজন কৃষক গবেষণা বাজেট ছাড়াই শুধু তাঁর প্রায়োগিক জ্ঞান, অধ্যবসায় ও পরিবার-সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়েই শত সহশ্র কৃষকের জন্য নতুন অধিক ফলনশীল ‘হরি ধান’ উদ্ভাবন করতে পারেন।
সদ্য প্রয়াত সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৌয়াল শাহাব উদ্দিন মোড়ল জীবনের প্রায় পুরো সময়টাকে ব্যয় করেছেন সুন্দরবনকে রক্ষার আন্দোলনে। “মায়ের মতন করেই নিজে ভালোবেসেছিলেন সুন্দরবনকে” আবার এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের সুন্দরবনকে রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। প্রয়াত মৌয়াল শাহাব উদ্দিন মোড়ল আর প্রয়াত মৌয়াল কাওছার মোড়লের উৎসাহে গড়ে উঠা “সুন্দরবণ সলিডারিটি টিম” আজ সুন্দরবন এলাকায় শুধু সুন্দরবন রক্ষায় নয়, পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষায় শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার পাশাপাশি এক আন্দোলনের নাম। নেত্রকোনার প্রয়াত জেলে নেতা অতূল চন্দ্র দাস জলাশয়ে প্রকৃত জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় “জাল-নদী-মাছ (জানমা)” এখন প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও একত্রে থাকার এক সাহসের নাম। এভাবেই প্রবীনের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর উৎসাহ এগিয়ে নিয়ে যায় নতুনদের, শত সহশ্র মানুষের স্বপ্ন আর ভালোবাসা পূরণের অঙ্গীকারে।
ময়মনসিংহের রিক্সাচালক জয়নাল আবেদীন ভিক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেছেন এলাকায় মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য “মমতাজ হাসপাতাল”। শ্রদ্ধেয় জয়নাল আবেদীন তো সবাইকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন “টাকা থাকলেই জীবের সেবা করার সৌভাগ্য সবার হয় না”। সিলেটের শ্রীরামপুরের একজন দুদু মিয়া অতিথি পাখিকে আশ্রয় দেয়ার জন্য নিজের বাড়িতে “পাখি বাড়ি” তৈরি করেন। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে বাড়ির সব দরজা খুলে দেয়া হয় যাতে পাখিরা নিরাপদে ঘরেই আশ্রয় নিতে পারে। হয়তো বাংলাদেশ এটাও সম্ভব। মানুষই পারে এ দেশে, মানুষই পারবে। সম্প্রতি নেত্রকোনার অভয়পাশায় অনুষ্ঠিত প্রাণবৈচিত্র্য মেলায় ৬৩৭ ধরনের ধান, ৭৫ ধরনের সবজি বীজ, ৯ জাতের পান, ৩৭ প্রকার দেশীয় ফল, ৩৫ রকম অচাষকৃত উদ্ভিদ, ১৯ রকম ভিন্ন ভিন্ন মাছের শুটকি ও ২৫ ধরনের বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় গাছ-পালার চারা প্রদর্শন করে নিজের অজান্তেই প্রাণের টানে আপন মনে সবাই গেয়ে উঠে—
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম আমার, মাগো তোমায় ভালোবেসে।
(লেখার শিরোনামটি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের কবিতার অংশ থেকে নেওয়া হয়েছে এবং শেষের দু’টি লাইন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে)