খরা ও মরুময়তার হুমকিতে বাংলাদেশ
এবিএম তৌহিদুল আলম
১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ জুন মাসের ১৭ তারিখকে আন্তর্জাতিক খরা ও মরুময়তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৯৫ সাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। মূলত, খরা ও মরুময়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা এবং খরা ও মরুময়তা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে সদস্য রাষ্ট্রদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস তৈরির তাগিদেই দিবসটি উদযাপিত হয়। ২০১৬ প্রতিপাদ্য হচ্ছে Inclusive cooperation for achieving Land Degradation Neutrality বা ‘ভূমিক্ষয় প্রশমনে সমন্বিত সহযোগিতা’।
একটি অঞ্চল তখনই মরুভূমি বা মরুঅঞ্চলে পরিণত হয় যখন শুষ্ক, অর্ধশুষ্ক বা ঈষৎ আর্দ্রভূমি ও অনাবৃষ্টিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়ে ভূমির অবক্ষয় ঘটায় এবং ক্রমশ মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গাছপালা শস্যাদি উৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়ে পর্যায়ক্রমে ধূ-ধূ বালিতে পরিণত হয়। ফলে এলাকাটি ক্রমশ প্রাণিকূলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। জাতিসংঘের মরুকরণ প্রক্রিয়া বিষয়ক সংগৃহীত সংশ্লিষ্ট তথ্যবিবরণী হতে জানা যায়, পৃথিবীর মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগেরও অধিক এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার ভয়ানক হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে এশিয়া এবং আফ্রিকায় মরু আক্রান্ত এলাকা সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীর বৃহৎ মরুভূমিগুলো ২০০-৩০০০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে অঞ্চলের মাঝে অবস্থিত। এর মধ্যে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা, অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি, আরব মরুভূমি, খর মরুভূমি, কালাহারি মরুভূমি, আটাকামা মরুভূমি, গোবি মরুভূমি প্রভৃতি। এই সব মরুঅঞ্চলের সীমানা নতুন নতুন এলাকায় মরুময়তার বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। বর্তমানে এশিয়া মহাদেশও মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আর বাংলাদেশ ২০০-৩০০০ উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত হওয়ায় মরু আক্রান্তের সম্ভাবনা ও অত্যন্ত প্রবল।
ইতোমধ্যে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকাতে মরুময়তার প্রাথমিক লক্ষণাদি দেখা দিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের তাপমাত্রার বিশেষ তারতম্য ঘটছে। মরু অঞ্চলের মত দিনে প্রচ- গরম আবার রাতে খানিকটা শীতের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মরু অঞ্চলে ক্যাকটাস জাতীয় বাবলা গাছসহ গুল্ম ঘাস জন্মে এবং শুষ্ক মৌসুমে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। রাজশাহীর বরেন্দ্র এলাকাতে এধরনের গাছ ও ঘাস দেখা যায় এবং মরু আবহাওয়ার প্রাথমিক লক্ষণাদি ক্রমান্বয়ে স্পষ্টতর হচ্ছে। ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরাঞ্চলে গত কয়েক বছরে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নি¤œমুখী। দেশে মধ্যম থেকে উচ্চমাত্রায় খরায় আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৫৫ লাখ হেক্টর যার প্রায় সবটাই এই এলাকায়। এখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নীচে নেমে যাচ্ছে। গ্রীষ্মকালে উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩ মিটার হতে ১৫/১৬ মিটারে নেমে যায় যা খরা ও মরুময়তার অন্যতম পূর্বলক্ষণ।
বাংলাদেশে মরুময়তার প্রধানতম কারণ হলো আন্তর্জাতিক নদীর অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহে নিয়ন্ত্রণ। দেশের মোট ২৩০টি নদ-নদীর মধ্যে প্রধান তিনটি নদী গঙ্গা, যমুনা ও মেঘনাসহ মোট ৫৭টি সীমান্ত নদী চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মায়ানমারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশ পড়েছে। ভারত সীমান্তের ওপর হতে আগত ৫৪টি নদীর পানি শুষ্ক মৌসুমে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করায় গঙ্গার ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। শুধু গঙ্গাতেই নয়, তিস্তা, ফেনী নদীসহ অভিন্ন নদীতে বাঁধ, গ্রোয়েন ইত্যাদি নির্মাণের কারণে বাংলাদেশের সবুজ মাটি মরুকরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শুধুমাত্র গঙ্গানদীর ওপর নির্মিত ফারাক্কা ব্যারেজের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষত বরেন্দ্র এলাকায় প্রায় ৮০০০ বর্গ কি. মি. এলাকায় মরুকরণের আলামত দেখা দিয়েছে। আর প্রায় ২৫০০০ বর্গ কি.মি. এলাকার কৃষিজমির গুণাগুণ লোপ পেয়েছে। বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকা এবং ৩৮ শতাংশ বা ৪০ মিলিয়ন মানুষ খরা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মরুময়তার ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য নদীতে অবকাঠামো নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার, বিপুল পরিমাণ নদীবাহিত পলি, শুষ্ক মৌসুমে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির অভাব এবং পানি দূষণও মরুময়তার কারণ।
মরুময়তার প্রধান কারণগুলো সাধারণত দ্ভুাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত: ভৌগোলিক কারণ যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক খরা, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমির অবলুপ্তি ফলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: আঞ্চলিক কারণ যা আঞ্চলিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। যেমন পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত সাধারণত মৌসুমী বায়ুর ওপর নির্ভলশীল থাকায় গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত এবং শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এটা আঞ্চলিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। ফলে আঞ্চলিক বৃষ্টিপাত কম হলে বাংলাদেশে ও বৃষ্টিপাত কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং আঞ্চলিক খরা বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। মে মাসের প্রারম্ভে বঙ্গোপসাগর হতে আসা উষ্ণ আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ে বাধা প্রাপ্ত হলে বৃষ্টিপাত হয়। মে হতে অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র মৌসুমী বায়ু দ্বারা বৃষ্টিপাত ঘটে। শীতকালে বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এ সময় মৌসুমী বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক হতে দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু তা স্থলভাগ হতে আসে বলে জলীয়বাষ্পহীন থাকে। তাই বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত মৌসুমী বায়ুর নির্ভরশীল। ইদানীং বৃষ্টিপাতের মাত্রা এবং পরিমাণ কম হওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আবার দেশের খরা পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, পরিবেশগত ভারসাম্যের অবনতি, বনভূমি ধ্বংস, ভৌগোলিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া, পানি প্রত্যাহার ও সময়োপযোগী সুষম বৃষ্টিপাতের অভাব এই কারণগুলোই অন্যতম।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কারণে পানি চাহিদা অত্যন্ত প্রকট হওয়া সত্ত্বেও শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম। আবার বর্ষাকালে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হলে সেচ, কৃষি, ফসল উৎপাদনসহ বিভিন কাজে নিদারুন পানিসংকট দেখা দেয়। সার্বিক পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, বাংলাদেশে তখনই খরা হয় যখন কম বৃষ্টিপাত হয় এতে ভূ-গর্ভস্থ পানি পুনর্ভরণ হ্রাস পায়, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদিতে পূর্বের চেয়ে কম পানি থাকে। এমনকি ভূ-উপরিস্থ অধিকাংশ জলাশয় শুকিয়ে গৃহস্থালী কাজেও পানির প্রকট সংকট দেখা দেয়। প্রকৃতিতে শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাসিক ও বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত সুষম নয়। ১৯৫১ সাল হতে ১৯৮০ সালের (ত্রিশ বছরের) বৃষ্টিপাতের গড় প্রায় ২২৪০ মি.মি.। ১৯৮১ সাল হতে ২০১০ সালে (ত্রিশ) পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাতে পরিমাণ ২১৭০ মি.মি.। ২০১২-১৩ সালের বর্ষা মৌসুমে আমন উৎপাদন কম হয়েছে। ২০১৪ সালে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলেও দেশের অনেক স্থানে খরা পরিস্থিতি বিরাজমান। ২০১৩ সালের বৃষ্টিপাতের তুলনায় ২০১৪ সালের বৃষ্টিপাত ছিল ১৫% হতে ৩৫% কম।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী-নালা, খাল-বিল মৃত প্রায়। পানির জন্য হাহাকার গোটা উত্তর জনপদ জুড়ে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেয়ায় স্রোত হারিয়ে নদীগুলো পানিশূন্য ভরাট হয়ে একের পর মারা যাচ্ছে। এককালে যেসব নদীতে নৌকা বা লঞ্চ চলাচল করত, সে সব নদী এখন পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া যায়। অনেক নদীতে হচ্ছে চাষাবাদ। অনেক নদী এখন পাঠ্যপুস্তকে আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাস করানোই হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে যে বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। সার্বিকভাবে নদীর পানির স্তর এতোটা নিচে নেমে গেছে যে, কুয়া, ইঁদারা তো দূরের কথা, খাবার পানির জন্য টিউবওয়েল দিয়েও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পানি উঠছে না। নির্ভর করতে হচ্ছে ডিপটিবওয়েলের ওপর। আর ডিপটিউবয়েলের ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির স্তর আরো নীচে নেমে যাচ্ছে। ফলে উত্তরবঙ্গ এখন মরু প্রকৃতির মুখোমুখি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী পানিশূন্য এবং বিশাল চর জেগে ওঠায় সেচ সুবিধা এখন হুমকির মুখে। সেচের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫টি উপজেলার নলকূপগুলোতে পানি না উঠায় মানুষ সুপেয় পনি পেতে দুর্ভোগে পড়েছে। তিস্তার অভিশাপে হারিয়ে গেছে বগুড়ার অসংখ্য খাল-বিল, অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক নদী। উত্তর জনপদের সীমান্তবর্তী জেলা জয়পুরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চারটি নদীই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে অন্যান্য খাল-খাড়ি। নওগাঁর এক সময়ের খরস্রোতা আত্রাই নদী এখন মৃতপ্রায়। ৫০ কি.মি. দৈর্ঘ্য এ নদীটি ভারত থেকে এসে নওগাঁ জেলায় প্রবেশ করে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়েছে যা এখন শুধু বালুচর আর বালুচর। গভীরতা কমে যাওয়ায় মানুষজন এখন হেঁটে চলছে আত্রাই নদীর বুক দিয়ে। আত্রাই এখন শুধু কালের সাক্ষী। আত্রাই তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমিতে বোরো আবাদ চরম হুমকির মুখে। সেচ পাম্পগুলো দিয়ে পর্যন্ত পানি উত্তোলন না হওয়ায় হাজার হাজার কৃষক দিশেহারা। নদীটির মধ্যে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। একের পর এক উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করায় দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের ৮ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সকল নদ-নদী এখন প্রায় মরা খালে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭-এর সংজ্ঞা অনুসারে পৃথিবীর ২৬৩টি নদী ও পানিপ্রবাহকে ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কনভেনশনের ২(৬) ধারায় বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ’ বলতে এমন পানিপ্রবাহকে বোঝানো হবে যার অংশবিশেষ বিভিন্ন দেশে অবস্থিত। ১৯৯২ সালের হেলসিংকি চুক্তির ১(১) ধারায় এ ধরনের পানিপ্রবাহের সংজ্ঞায় ‘আন্তঃসীমান্ত জলরাশি’ বলতে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির কথা বলা হয়েছে যা দুই বা ততোধিক দেশের মধ্যে প্রবাহিত। এসব আন্তঃসীমান্ত জলরাশি দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে কোনো একটি দেশসংলগ্ন সাগরে গিয়ে মিলিত হয়। ভারত, চীন ও মিয়ানমারের উৎপত্তি হয়ে বিপুল সংখ্যক আন্তর্জাতিক নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মোট ৫৪টি নদী ও উপনদী ভারত এবং মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। হেলসিংকি এগ্রিমেন্ট ১৯৯২, জাতিসংঘ কনভেনশন ১৯৯৭, বার্লিন রুলস ২০০৪ লঙ্ঘন করে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ আন্তর্জাতিক নদীর পানিই একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে প্রতিবেশী দেশ যা দেশে মর”ময়তার অন্যতম কারণ।
প্রকাশিত একটি তথ্যে জানা গেছে, চলনবিল অঞ্চলে গত ৪ বছরে পানির স্তর নেমেছে ১৭ দশমিক ৩ ফুট। পানির স্তর ওঠানামা করে বৃষ্টিপাতের ওপর। দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে বৃষ্টি না হওয়ায় পানির স্তর নামতে শুরু করেছে। বর্তমানে তা আশঙ্কাজনক অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বরেন্দ্র অঞ্চল অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে। রাজশাহী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী বরেন্দ্র অঞ্চলের তানোর উপজেলার তালন্দ ইউনিয়নে পানির স্তর ১০০ ফুট, চান্দুড়িয়ায় ৯০, সরনজাই ৯০, বাধাইড় ১০০, পাঁচন্দর ৯০, কমলা ৮০, কামারগাঁ ৯০, তানোর পৌর এলাকায় ৯০ ও মুন্ডুমালা পৌর এলাকায় ১০০ ফুট নিচে রয়েছে। গোদাগাড়ী উপজেলার দেউপাড়ায় ৮৫.৫ ফুট, বাসুদেবপুর ৮২, মাটিকাটা ৮৩.৩৩, গোগ্রাম ৭৫.৭৫ ঋষিকূল ৮৪.৫, পাকড়ি ৮৫.২৫, চর আষাড়িয়াদহ ৩২.৫ মোহনপুর ৮১.৫ গোদাগাড়ী ৮৫, পৌর এলাকায় ৮৫.৩৩ ও কাকনহাট পৌর এলাকায় ৮১.২৫ ফুট নিচে। গত বছরের ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যানুযায়ী তানোর উপজেলায় গড়ে এপ্রিলে ৩৯.২ ও মে মাসে ৯৮.৯ ফুট নিচে পানি স্তর ছিল। গোদাগাড়ী উপজেলায় এপ্রিলে ৭৭.৮ ফুট ও মে মাসে ৭০.৪ ফুট।
বাংলাদেশে মরুময়তা প্রতিরোধকল্পে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। মরুময়তা প্রতিকারের প্রধান বিষয়গুলো স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ এই তিনভাগে গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বল্পমেয়াদী প্রতিকার হিসাবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সাথে প্রয়োজনীয় পানি প্রাপ্তি বিষয়ে সমঝোতা স্থাপন, সেচ ব্যবস্থা উন্নতকরণ, উন্নত ফসল ব্যবস্থাপনা ও মাটির ঊর্বরতা বৃদ্ধি এবং ভূমির সুষম ব্যবহার, বনায়নে উদ্বুুদ্ধকরণ, বর্তমান মরুময় এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মরুময়তা দূরীকরণে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি কার্যক্রমগুলো নিয়ে একটি অপঃরড়হ চষধহ তৈরি করে তার বাস্তবায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার। পাশাপাশি মরুময়তা দূরীকরণের উপর সমীক্ষা, গবেষণা এবং বস্তনিষ্ঠ উপাত্তসহ প্রতিবেদন তৈরিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদী প্রতিকারের অংশ হিসাবে জাতিসংঘের মরুময়তা সংক্রান্ত সম্মেলনের ১০নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশে একটি জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন যেখানে স্থানীয় উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন হবে এবং সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করতে পারবে পাশাপাশি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জনগণের দারিদ্র্য দূর করা যাবে। মরুময়তা দূরীকরণের অন্যান্য দেশের কর্মপন্থা ও অতীতের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো, আঞ্চলিক আবহাওয়া অনুসারে মাটির পরিবর্তনশীল গুণগতমান অনুসারে উপযুক্ত চাষাবাদ পদ্ধতির প্রবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ এই দু’য়ের সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করা। পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণ রোধের জন্যে প্রয়োজনীয় এবং উপযোগী জাতীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে যাতে শ্রেণীভিত্তিক জমির সংরক্ষণ, পানি সম্পদের সুষম সংরক্ষণ ও ব্যবহার ইত্যাদি কার্যক্রম সমন্বিত থাকবে। পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যাবশ্যক। প্রচারপত্র, পুস্তিকা, গণমাধ্যম প্রচার যন্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক প্রচার এবং স্কুলপর্যায়ে পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থার শিক্ষাক্রম চালু করা প্রয়োজন। দেশের এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক খরা ও মরুময়তার অবস্থা/প্রভাব নিরূপণ এবং সময় উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে জাতীয় পর্যায়ে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকার হিসাবে গঙ্গা ও আন্তর্জাতিক নদীসমূহের বিশেষভাবে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালার উপরভিত্তি করে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ও মৎস্য সম্পদসহ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এখন থেকেই পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নিতে হবে। মরুময়তার লক্ষণ দেখা যায় এমন জায়গায় ভূমিক্ষয় রোধ ব্যাপক বৃক্ষ রোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপক কর্মসূচী নেওয়া যেতে পারে। ছোট ছোট খাল-বিল, নদী-নালায় পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির সংরক্ষণ করতে হবে কারণ ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ সীমিত। পরিবেশ অবক্ষয় ও দূষণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই খরা ও মরুময়তা সৃষ্টি প্রবণতাকে রোধ করা সম্ভব। মরুময়তা একটি জাতীয় বিপর্যয়। সুতরাং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হতে উপযুক্ত লোকবল এবং জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় শক্তিশালী মনিটরিং সংস্থা গঠন করার পাশাপাশি মরুময়তার উপাত্ত সংগ্রহ করা ও প্রয়োজনীয় ধারাবাহিক গবেষণার জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বর্তমানে বিশ্বে পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতার নিয়ামক হিসাবে কাজ করছে অপরিনামদর্শী উন্নয়ন উদ্যোগ আর আয় ও ভোগ-বৃদ্ধির প্রানান্ত প্রয়াস। অধিক আয় ও ভোগের চাহিদা মেটাতে স্থাপিত হচ্ছে শিল্প-কলকারখানা। বাড়ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। তাই আমাদের বসবাসের এই একমাত্র পৃথিবীর আবহাওয়ায় দেখা যাচ্ছে বিরূপ পরিবর্তন। বায়ুম-ল, মাটি ও পানি হয়ে পড়ছে বিষক্রিয়ার শিকার যা প্রাণী ও বৃক্ষকূলের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। ফলে মানুষ এখন পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে তা পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না। বরং সম্পদহীনতা কখনো কখনো বাধ্য করছে নির্দয়ভাবে প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সম্পদ আহরণ করতে। তাই বাংলাদেশের উদ্ভূত বিরূপ পরিবেশ এবং মরুপ্রক্রিয়া রোধে সরকার, জনসাধারণ, প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতায় এক যোগে কাজ করতে পারলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।