আমার মাধ্যমে অন্যের উপকার হলেই আমি শান্তি পাই

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার

নারীদের সারাদিনের অনেক কাজের মধ্য একটি কাজ হচ্ছে রান্না করে পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করা। আর প্রান্তিক নারীদের এ কাজের প্রধান অনুসঙ্গ হলো চুলা। অনেক প্রকারের চুলার মধ্য প্রান্তিক নারীদের লোকায়ত পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব চুলা অন্যতম। অনেক সময় দেখা গেছে, অন্য চুলা ব্যবহারের কারণে প্রান্তিক নারীদের চোখের বিভন্ন সমস্যা দেখা দেয়। চোখ জ্বালাপোড়া করা নিত্যদিনের সমস্যা ছিলো। প্রান্তিক নারীদের মাঝে তাই পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তেমনই একটি গল্প রাজশাহীর তানোর উপজেলার চিমনা গ্রামের সনিতা রানীর (৪৫),স্বামী শ্রী সনাতন কুমার (৫৫) পেশায় একজন কৃষক।

সনিতা রানী ২০২১ সালে হরিদেবপুর গ্রামের এক আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে যান। এখানে উল্লেখ যে, বারসিক’র সহযোগিতায় তানোর উপজেলারই হরিদেবপুর গ্রামটি শতভাগ পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহারকারি গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই গ্রামের কবুলজান বেগমের নিজের উদ্ভাবনের পরিবেশবান্ধব চুলাই বরেন্দ্র এলাকার হাজারো নারী ব্যবহার করছেন। আত্মীয়র বাড়িতে পরিবেশবান্ধব চুলায় রান্না করা দেখে সনিতা রানী দেখেন এই চুলায় কোন ধোয়া হচ্ছে না, আবার রান্নাও অনেক তারাতারি হচ্ছে। তিনি এই চুলার খুটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেন। এই চুলা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে ফিরে তিনি নিজে নিজে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরির চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে সনিতা রানী বলেন, ‘এই চুলার সব থেকে ভালো দিক হচ্ছে এটার ধোঁয়া বাইরে পাইপ দিয়ে বের হয়ে যায়। যার ফলে চোখ জ্বালাপোড়া করে না। তাই আমি আমার বাড়িতে এই চুলা তৈরির পরিবকল্পনা করি।’ তিনি আরো জানান, প্রথম দুইবার তিনি এ কাজে সফল হতে পারেনি। তৃতীয়বারে ভালোভাবে তৈরি করতে সফল হন।

এভাবেই চলছিলো সনিতা রানী খুব অল্প সময়ে চোখ জ্বোলাপোড়া ছাড়াই রান্নার কাজ শেষ করতেন। চিমনা গ্রামের অন্য নারীরা সচিতা রানীর চুলার ব্যবহার দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের বাড়িতে তৈরি করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই শুরু প্রথমে গ্রামের আরতী বালাকে (৪৬) এই চুলা তৈরি করে দেন। আরতী বালার সাথে এ বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার চোখে সমস্যা ছিলো রান্নার সময় ধোঁয়া লাগলে অনেক বেশি কষ্ট হতো। এ চুলায় রান্নার সময় কোন ধোঁয়া হয় না। তাই আমি এই চুলা বনিয়ে নিয়েছি। এখন রান্না করে শান্তি পাই।’ এ কথা শুনে অপর একজন নারী মোসা: মর্জিনা বেগম (৩৫) বলেন, ‘আমার গরিব মানুষ তাই রান্নার কাজে আমাদের চুলাই ভরসা। এই পরিবেশবান্ধব চুলায় রান্না করতে জ্বালানি অনেক কম লাগে। মাত্র ২০০-৩০০ টাকা দিয়ে পাইপ কিন শুধু মাটি আর ইট দিয়েই এ চুলা তৈরি হয়ে যায়।

সনিতা রানী একে একে চিমনা গ্রামের ৩৬জন নারীকে এই চুলা তৈরি করে দিয়েছেন বিনামূল্যে। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘গ্রামের একজন ভালো কোন কাজ পারলে আন্তরিকতার জন্যই অন্যদের ওই কাজে সহযোগিতা করতে হয়। অন্যরা খুশি হয় এতেই আমার ভালো লাগে।’ এ কাজের টাকার মূল্য আছে জানালে সনিতা রানী হেসে বলেন, ‘গ্রামে একসাথে চলতে গেলে সব কাজে টাকার চিন্তা করলে চলে না। আমার মাধ্যমে আমার পতিবেশির উপকার হচ্ছে এই অনেক বড়।’

শুধু পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি করতেই পারদর্শীতা অর্জন করেননি সনিতা রানী। নিজের ৮শতাংশ বাড়ির পতিত জায়গায়, ঘরের চালায়, উঠানের পাশে,রান্না ঘরের চালায় মৌসুমী সবজির চাষ এবং সে সবজির বীজ সংরক্ষণ করতে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সব সময় তিনি সবজি চাষ করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয় করেন। তিনি জানালেন, “এবার আমি ৫ হাজার ৩শ’ টাকার লাউ ও চাল কুমড়া বিক্রয় করেছি, যা দিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েও আমার স্বামীর হাতে কিছু টাকা দিতে পেরেছি।’ সনিতা রানীর এই কার্যক্রম বিষয়ে তার স্বামী শ্রী সনাতন কুমার বলেন, “তার সবজি চাষের মাধ্যমে আমাদেও খাওয়ার চাহিদা মেটানোর পরও অনেকগুলো বিক্রয় করা যায়, যা আমাদের সংসার চালাতে সহজ হয়। এখান থেকে আমরা বীজ রাখি বলে বীজ বাজার থেকে কিনতেও হয় না। অনেকে এসে আমাদের থেকে বীজ নিয়েও যায়। আমি আমার স্ত্রীর কাজে সব সময় সহযোগিতা করি।’

গ্রামের প্রান্তিক নারীরা নিজেদের কাজের মাধ্যমেই প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভূমিকা রাখে। সনিতা রানী হয়তো জানেনই না তার তৈরি করা ৩৬টি পরিবেশবান্ধব চুলা প্রতিদিন কত কম কার্বন নিঃসরন করে এই দেশ তথা পৃথিবীর মঙ্গল করছেন।

happy wheels 2

Comments