স্বনির্ভর নারী হামিদা আক্তার
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
গ্রামের একটি পরিবারের উপার্জনের মূল উৎস হলো কৃষিকাজ এবং এর মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা। সেই শস্য, অর্থ দিয়ে সংসারের চাহিদা পূরণ করা। এককভাবে শুধু শস্য ফসল দিয়েও সংসারের নিত্য নতুন প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। তাছাড়া শুধু ধান, সব্জী চাষ করলেই সেটাকে কৃষি বলা যায় না। যিনি চাষ করেন তিনিও শুধুমাত্র কৃষক নন। একটি গ্রামীণ পরিবারের উপার্জনের আরো বিভিন্ন উৎস থাকতে পারে। যেমন-হাঁস মুরগি পালন, মাছ চাষ, কুটির শিল্প অথবা গবাদি পশু পালন। ঘরের দাওয়ায় একটি বারোমাসী বেগুন বা মরিচের চারা রোপণ করে রাখাও কৃষিকাজের অংশ। আর এই কাজগুলো অধিকাংশ সময়েই বাড়ির নারীরা করে থাকেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কৃষক বলতে নারাজ। হাটে, মাঠে যেখানেই আলোচনা হোক না কেন কৃষক মানেই পুরুষ ব্যক্তি এবং তিনিই উৎপাদন করে সংসার চালান।
কোন জমিতে কি ধান লাগাবেন, কতটুকু সার দিতে হবে, সমস্ত কর্তৃত্বই পুরুষ নিজের দখলে রাখতে চান। সেখানে হয়তো অন্য কৃষকদের পরামর্শ নেওয়া চলে কিন্তু নারীর নয়। গৃহকর্ত্রীর নয়। এই যে এবার ধানের দাম কম গেলো এ নিয়ে তাঁদের আলোচনার ঝড় উঠেছে বাজারে, দোকানে, চায়ের স্টলে। কারণ বর্তমান সময়ে ধান আমাদের প্রধান শস্য ফসল হিসেবে চাষ হচ্ছে। তবে এর পাশাপাশি অন্যান্য ফসল চাষে কৃষকগণ মনোযোগ দিলে বা বাড়ির নারীর চাষে সহযোগিতা করলে এমন হতাশ হতে হতো না। অনেক নারীকেই বলতে শোনা যায়, অমুকের আব্বা ফসল কৃষি করতে দেয়না। হাঁস মুরগি কিনে দেয় না। পুরুষক কৃষক যদি তা হতে দিতো তাহলে গ্রাম বাংলার প্রতি ঘরে দু’জন করে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি থাকতো।
‘করতে দেয়না’, ‘কিনে দেয় না’ -এসবের বাইরে গিয়ে হামিদা আক্তার নিজে উপার্জন করতে শিখেছেন। নিজ গ্রামে তাঁর একটা পরিচিতি তুলে ধরেছেন। সেই কবে, ছোট বয়সে বৌ হয়ে এসেছিলেন লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া গ্রামের সাইফুল মুনশীর ঘরে। শ্বশুর বাড়িতে এসেই তাঁকে অভাবের মুখে পড়তে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর শ্বশুর মারা গেলেন। তাঁর স্বামী ছিল পরিবারের বড় সন্তান। তাই সকল দায়িত্ব তাঁদেরকেই পালন করতে হয়। বাড়িতে ছোট ছোট ননদ, দেবর, শ্বাশুড়িসহ সকলের খাওয়াপড়ার ভার নিতে হলো। তাঁর স্বামী তখন স্থানীয় একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে কাজ করেন। এই অল্প রোজগারে বড় সংসার চালাতে গিয়ে প্রায়ই তিনি না খেয়ে থাকতেন। জমি নেই, বসতভিটায় জায়গার পরিমাণও খুব কম। তাই হামিদা আক্তার ঠিক করলেন গরু পালন করবেন।
যেই ভাবা, সেই কাজ। পার্শ্ববর্তী গ্রাম বাইশদারে তাঁর বাবার বাড়ি। সেখানকার অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। স্বামীকে বলেছিলেন একটি গরু কিনে দিতে। কিন্তু অর্থের অভাবে স্বামী পারেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে একটি গাভী কিনে আনলেন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ তিনি গরু পালন করে আসছেন।
প্রথম দিকে স্বামী একটু অমত করেছিলেন, ইমাম সাহেবের বৌ কিনা গরু পালন করবেন! কিন্তু হামিদা আক্তারও নাছোরবান্দা। তিনি এ কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যাবেন না বলে স্বামীর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে নেন। তাই গরুর খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া, ভাতের মাড় ইত্যাদি খাওয়াতে থাকেন। কিন্তু গরুর প্রধান খাবার হলো ঘাস। এটি তিনি কিভাবে সংগ্রহ করবেন? শেষে দেবরকে দিয়ে ঘাস সংগ্রহ করা শুরু করলেন। বিনিময়ে তাকে বিভিন্ন ধরণের মজাদার খাবার রান্না করে দিতে হতো। এভাবে কিছুদিন যেতে থাকে। দেবরটিও এক সময় কাজের উদ্যেশ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তখন তিনি নিজ বাড়ির আশেপাশে জন্মানো ঘাস সংগ্রহ করেন। পাড়ার ছেলেদের পয়সা দেন ঘাস এনে দিতে। এভাবে আরো কিছু দিন যায়।
এক সময় তাঁর গাভীটি বাচ্চা প্রসব করে। তখন দুইটি প্রাণির খাবার তাঁকে সংগ্রহ করতে হবে। অন্যের উপরে ভরসা করে আর চলা যাচ্ছে না। স্বামীও খেয়াল করলেন গরু পালনে তিনি কতটা যত্নবান। তাই তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘাস সংগ্রহ করে দিতেন। কখনো বা খড় এনে দিতেন। এভাবেই চলতে লাগলো হামিদা আক্তারের গরু পালন।
বাছুরটি একটু বড় হলে গাভীটি রেখে সেটি বিক্রি করে দিলেন। বাছুর বিক্রির টাকায় একটি ষাঁড় বাছুর কিনে আনলেন। কখনো খড়, ভূষি আর কখনো বা কচু শাকের সাথে চালের কুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করেন এক বিশেষ ধরণের খাবার। এই খাবার দুধ দেয়া গরুকে খাওয়ালে দুধ আরো বেশি দেয়। এই দু’টি উপকরণ এক সাথে মিশিয়ে এক প্রকার তরল খাবার রান্না করেন। গরু যখন দুধ দেয় তখন এই খাবার প্রতিদিন খাওয়াতে হয়। দুধ নিজেদের খাবারের জন্য রেখে দিয়ে বাকিটা বিক্রি করে দেন। সেই টাকা তিনি সংসারের নানা চাহিদা মেটাতে ব্যবহার করেন।
হামিদা আক্তারের গোয়ালে সব সময় ৪/৫টি গরু থাকে। গরুর ঘর পরিষ্কার করা, সময় মতো খাবার দেওয়া এগুলো তিনি একাই করেন। ষাঁড় গরুগুলোর যত্ন নিতে অনেক কষ্ট হয়। তবুও তিনি এগুলো পালন করেন। কারণ এই ষাঁড় বিক্রি করলে বেশি টাকা পাওয়া যায়। গরু/ষাঁড় বিক্রি করার টাকা দিয়ে তিনি বাড়িতে দালান ঘর তুলেছেন। দূর্ঘটনায় তাঁর ছেলের হাত ভেঙে গিয়েছিল, সেই চিকিৎসায় খরচের অধিকাংশই তিনি বহন করেন।
সংসারের সকল কাজের পাশাপাশি গরু পালনের কাজটি তিনি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করে থাকেন। সময়মতো গরুর খাবার দেয়া, প্রয়োজনে গোসল করানো, খাবার দেয়া সবই তিনি নিজেই করেন। গরুর খাবারের জন্য গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে চালের কুঁড়া কিনে আনেন। নিজেদের যেহেতু জমি নেই তাই খড়ও নেই। খড় কিনতে গেরস্ত বাড়ি থেকে। এসব তিনি নিজেই করেন। এখন আর স্বামী তাঁর কাজে বাধা দেয়না। প্রয়োজনে তিনিও সহযোগিতা করেন। এছাড়া তাঁর কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির ছোট ছোট সদস্যরা। তারা মজাদার খাবারের লোভে বড়মা’র (ননদ/দেবরের ছেলেমেয়েরা তাঁকে বড়মা বলে ডাকে) গরুর জন্য কচুশাক সংগ্রহ করে দেয়। ঘাস তুলে দেয়। বিনিময়ে তিনি তাদের অনেক প্রকারের খাবার তৈরি করে দেন। গরু বিক্রির টাকা দিয়ে সংসার খরচেও সহযোগিতা করেন। ননদ/ দেবরের বিয়েতে সহযোগিতা করেছেন। ছেলেকে পড়াচ্ছেন, নিজের মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। শখ পূরণ করতে পারেন।
এবছর বিশ্ব খাদ্য দিবসে বারসিক আয়োজিত কৃষক সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়। নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি অন্যান্য কৃষকদের সাথে যোগ দিয়ে সম্মাননা গ্রহণ করেন। গ্রামের একজন সাধারণ নারী এই সম্মাননা পাবার পরও তিনি বুঝতে পারেননি কেন পুরষ্কার পেলেন। কারণ তিনি তো পুরষ্কার পাবার মতো কিছুই করেননি। তিনি মনে করেন এটা তাঁর কাজ। তিনি যেহেতু লেখাপড়া করেননি, তাই চাকরি করতে পারবেন না। চাকরি করলে মানুষ বিভিন্ন পুরষ্কার, সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। তিনি তো ঘরের কাজই করেন। গরু পালনের কাজকে তিনি সংসারের কাজ হিসেবেই দেখেন।
হামিদা আক্তার একজন নিরক্ষর নারী হয়ে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে সহযোগিতা করছেন। তাছাড়া নিজে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাঁর এই কাজটিকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এই কাজে অনেক পুরুষরাই একনিষ্ঠ থাকতে পারেন না। গরু পালনের জন্য তিনি আধুনিক কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করেন না। নিজের মা’র কাছে শিখেছিলেন কোন ধরণের খাবার দিলে গরু বেশি দুধ দেয়, স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই তিনি প্রয়োগ করেন। তাঁর কাছে অনেকেই পরামর্শ নিতে আসে কিভাবে গরু পালন করতে হয়। যতদিন শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকবে, ততদিন তিনি এই কাজ করে যেতে চান বলে তিনি জানান।