হতাশা কাটিয়ে আলোর পথে শাহিদা

সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শারমিন আক্তার
ভালোভাবে বেঁেচ থাকার প্রবল প্রচেষ্টার কাছে হার মেনেছে দৈহিক অক্ষমতা। সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের শাহিদা বেগম (৩০)। বারো বছর আগে জ্বর হয় শাহিদার। গ্রাম্য ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় শুকিয়ে যায় ডান পা। পরিবার থেকে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না পারায় সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয় শাহিদাকে। দরিদ্র পিতা নির্বাক দর্শকের মত দেখেছে শাহিদার অসহায়ত্বকে গ্রাস করার দৃশ্য। তবে নিজের প্রচেষ্টায় শাহিদা দারিদ্র্যতাকে জয় করেছেন। পরিবার এবং সমাজের কাছে সে এখন জীবন যুদ্ধে জয়ী এক গর্বিত সৈনিক।


পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে শাহিদা বড়। ধার দেনা করে অন্য ৩ বোনের বিয়ে দিতে পারলেও পঙ্গুত্ব বাদ সাধে শাহিদার বিয়ের ক্ষেত্রে। যারাই দেখতে আসে তারাই ব্যঙ্গ এবং উপহাস করে শাহিদার দুর্দশা দেখে। শাহিদার মা বাবাকে শুনতে হয় সমাজের নানা কটুক্তি। অবশেষে মানিকগঞ্জের সরুপাই গ্রামের রাজ্জাক মিয়া তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। তবে শর্ত থাকে বাড়ি করার জমি ও ঘর দিয়ে দিতে হবে। রাজি হয় শাহিদার মা-বাবা।
শাহিদা শারীরিকভাবে অক্ষম। স্বামী আ: রাজ্জাক ছিলো দিমুজুর। বিবাহিত জীবনেও আর্থিক দৈন্যতা পিছু ছাড়ে না শাহিদার। বাপের বাড়িতে দিন কাটতে থাকে শাহিদার। এতে নিজের পরিবার থেকে নানান কথা শুনতে হয় প্রতিনিয়ত। অবশেষে তিন বছর পর শাহিদা দিনমুজর স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়ির এলাকায় আলাদাভাবে ঘর বাঁধে। শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।


কাথা সেলাইয়ের কাজ জানতো শাহিদা। কাথা সেলাই দিয়ে নিজের রোজগার শুরু করেন তিনি। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কাথা এনে শুরু করেন তিনি। প্রতিটি কাথা থেকে দুইশত থেকে আড়াইশত টাকা মজুরি পেতো। এতে তার প্রতিমাসে পনের’শ থেকে দুই হাজার টাকা আয় হতে থাকে। বাপের দেওয়া একটি ১১ শতাংশ জমিতে একটি দোচালা ঘরে স্বামীর দিনমজুরির টাকা এবং নিজের আয় দিয়ে চালিয়ে নিতে থাকে নিজের সংসার।
আজ থেকে ১৫ বছর আগের কথা। সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য শাহিদা দিন মজুরের কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পঙ্গু বলে কেউই কাজে নিতে রাজি হয় না। সেক্ষেত্রে কম মজুরিতে (প্রতিদিন ১৫০ টাকা) কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় শাহিদা। এবার কাজ মিলতে শুরু করে। অন্যদিকে কাথা সেলাইয়ের কাজ করে বারো হাজার জমা হয় তার। উক্ত টাকা দিয়ে একটি বাছুর গরু ক্রয় করে। পাশাপাশি অন্যের গরু ছাগল বর্গা নিয়ে লালন পালন শুরু করেন তিনি। শুরু করেন হাঁস ও মুরগি পালন। আয় বাড়তে থাকে শাহিদার। দূর হতে থাকে সংসারে দৈন্যতা।


আজ শাহিদাকে দিন মজুরের কাজ করতে হয় না। নিজের ও স্বামীর আয় দিয়ে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে ১১০ শতাংশ জমি বন্ধক নিয়ে কৃষি কাজ করেন। বর্তমানে ২টি গরু আছে । যার আনুমানিক মূল্য দুই লক্ষাধিক টাকা। আছে বাড়ি ভরা হাঁস ও মুরগি। শাহিদা গরু, ছাগল, হাঁস ও মুরগিকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসাবে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে শাহিদা বলেন, ‘ওরা আমার আপনজন। ওরা আমার পরম বন্ধু। ওগো জন্যি আমি আমার সংসারের অভাব দুর করবার পারছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখন অনেক খুশি। আমার ভাবী (ভাইয়ের বউ) আমারে বোঝা মনে করে না। তারা আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসে।’


শাহিদার শেষ ইচ্ছা ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাবেন। নিজের দৈহিক এবং পরিবারের অসচ্ছলতাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হতে দেয়নি। তার ছেলের ক্ষেতে এটা হতে দিবেন না।


নিজের আগ্রহ ও মানসিক শক্তির জোরে শাহিদার সংসারে এসেছে স্বচ্ছলতা। স্বামী ও একটি ছেলে সন্তানকে নিয়ে তা তার ছোট্ট পরিবার সুখে আছেন তিনি।নিজের প্রচেষ্টা ও কর্মগুণে স্বামী ও সন্তান তাকে বসিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। শুধু তাই নয়; গ্রামের মানুষের কাছেও শাহিদা হয়ে উঠেছেন জীবন সংগ্রামী নারীর এক অনবদ্য উদাহরণ ।

happy wheels 2

Comments