প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে অর্চনা রানীর উদ্যোগ
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল লবণাক্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। তবে এই লবণাক্ততার মধ্যেই উপকূলীয় কৃষক-কৃষাণীরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাণ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন। অতীতে উপকূলীয় এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্য ভরা ছিলো। কিন্তু যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে ততই এগুলো কমতে শুরু করেছে। তারপরও এ এলাকার নারী ও পুরুষ পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে তারা নানান ধরনরে উদ্যোগ চলমান রেেেখছেন। এসব নারী ও পুরুষের মধ্যে শ্যামনগগর উপজেলার কাশিমাড়ি ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের কৃষাণী অর্চনা রানী মন্ডল অন্যতম।
অর্চনা রানীর পরিবারে সন্তানসহ মোট ৪জন সদস্য। স্বামী প্রভাস মন্ডল একজন দিনমজুর। মাঝে মধ্যে এলাকার বাইরে ভাটা ও ধান কাটার কাজে যান তিনি। এদিকে বাড়ির সব কাজ করতে হয় অর্চনা রানীকে। অর্চনা রানীর জমি জমা বলতে মোট দেড় বিঘা বসতভিটা। এই বসতভিটার মধ্যে ৫ কাঠার একটি পুকুর ও বাকিটা সবজির ক্ষেত ও বসতভিটা। বসতভিটায় তিনি বারোমাস বিভিন্ন ধরনের সবজি, মসলা, চাষ করেন। তাঁর বাড়িতে সবজির মধ্যে রয়েছে মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, লাউ, ঝিঙা, তরুল, চালকুমড়া, শসা, পাতাকপি, উচ্ছে, খিরাই, কচুরমুখী, বরবটি, আলু, ওলকপি, ঢেড়স, ওল, লাল শাক, মূলা, গাজর, পুইশাক, কলা, পেঁপে, চুবড়ি আলু, পালনশাক, বীটকপি, ডাটাশাক, কচু, কলা, পেপে, ঝাল, টমেটো, কচু, লাউ ইত্যাদি। মসলার মধ্যে রয়েছে ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, আদা, জিরা, এলাচ, ডালের মধ্যে রয়েছে কলুই এবং তেলের মধ্যে সরিষা।
এছাড়াও ফলজ গাছের মধ্যে তার বাড়িতে আছে আম, জাম, কাঁঠাল, বাতাবিলেবু, জামরুল, লিচু, তাল, খেজুর, কলা, ছবেদা, নারকেল, সুপারি, পাতিলেবু, কাগছিলেবু, পেপে, শাকআলু, আমড়া, পান, পেয়ারা, কুল, সজিনা, আনারস, বেল, ডুমুর, গাব গাছ। অচাষকৃত উদ্ভিদের মধ্যে থানকুনি, হেলাঞ্চ, বৌনুটি, আদাবরুন, আমরুল, তেলাকচু, সেঞ্চী, নোনাশাক, কাথাশাক, গিমেশাক, দূর্বা, তুলসি, কলমিশাক আছে। পুকুরে মাছের মধ্যে আছে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার, টেংরা, পুটি, ট্যাবলেট, জাপানিপুটি, শোল, কই, তোড়া, মরুল্য, কাঁকড়া, চিংড়ি, তেলাপিয়া, বাইন, মাগুর মাছ প্রভৃতি। অন্যদিকে প্রাণী সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১৪টি মুরগি, ৬টি হাঁস, ৪টি ছাগল, ৫টি গরু এবং ৩টি কবুতর।
প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে আগ্রহী ও উদ্দীপনা সম্পর্কে অর্চনা রানীর কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার বাড়িটা একটি কৃষিবাড়ি। এ বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের সম্পদে ভরপুর করতেছি। ভবিষ্যতে আরো বাড়াবো। আমি বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসে দেখি এখানে অভাব। স্বামীদের এ বসতভিটা ছাড়া কোন জমি নেই। স্বামী বিভিন্ন সময়ে যোন মজুরি দিতো তাতে খুব ভালো সংসার চলত না। পরিবারে অসুখ বিসুখ হলেই নানান আর্থিক সমস্যায় পড়তে হয়। অন্যের কাছ থেকে ধার দেনা করতে হতো। এটা আমার কাছে ভালো লাগতো না। আমি বিয়ের আগে আমার বাবার বাড়িতে মা বাবার সাথে সবজী চাষ করতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘সংসারের অবস্থা দেখে বাপের বাড়ির সবজি চাষের সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগালাম। স্বামী স্ত্রী মিলে পরিকল্পনা করে ভিটার উপর মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করতে শুরু করি। পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষও করি। সাথে প্রতিবছর বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ লাগাতে থাকি। হাঁস-মুরগি পালন করি। এভাবে কয়েক বছর পর একটি গরু ক্রয় করি। এভাবে আস্তে আস্তে বাড়িতে নানা ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের চেষ্টা করি। এভাবে আজ আমি এখন সফল। ’
অর্চনা রানী জানান, গত ২০১৫ সালে উপজেলা কৃষি অফিসের সহায়তায় আইএফএম কৃষক মাঠ স্কুল চালু হয়। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষবাসের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখান থেকে বারসিক’র সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। বারসিক’র পরামর্শ ও সহায়তায় তিনি তাঁর বাড়িটাকে একটি ‘কৃষিবাড়ি’ হিসেবে গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। এভাবে ২০১৬ সালের শেষের দিকে তিনি একটি নারী সংগঠনও দাঁড় করান। সেখানেও বিভিন্ন ধরনের আলোচনা, প্রশিক্ষণ, মেলা ও সঞ্চয় কার্যক্রম চালু রয়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বারসিক’র যোগাযোগ সহায়তার জন্য একটি ডিপ টিউবওয়েল পেয়েছেন, যা দিয়ে তাঁর কৃষি কাজকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন সাথে গ্রামের সুপেয় পানির সমস্যাও লাঘব হয়েছে।
অর্চনা রানী বলেন, ‘আমার বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের প্রাণ সম্পদ থাকায় তাতে যেমন আমার পরিবার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে তেমনি গ্রামের বিভিন্ন মানুষকে নানান সময় বীজ, সবজি, পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতে পারছি। এই করোনাকালীন সময়ে আমাদের অনেকের কাজ বন্ধ থাকলেও আমার মতো কৃষক-কৃষাণীদের কাজ বন্ধ হয়নি। এসময় গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়স্বজনদের সবজি ও বীজ দিয়ে সহায়তা করেছি। এছাড়াও বারসিক যে শতবাড়ি তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেখানেও আমার বাড়ি নির্বাচিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় উপকরণ দিয়ে সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রেখেছেন।’
উপকূলীয় এলাকায় অর্চনা রানীর মতো অসংখ্য নারী প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাদের কাজ ও উদ্যোগকে আরো গতিশীল করতে তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা প্রদান করা জরুরি। তাহলে হয়তোবা তারা আমাদের প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করতে আরো উৎসাহিত হবে এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।