সাগরিকা বেগমের প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহার
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার খারনৈ ইউনিয়নের কচুগড়া গ্রামে বাস করেন সাগরিকা বেগম। পরিবারে স্বামী ও সন্তান ছেলের বউ ও নাতী নাতনী সব মিলিয়ে ৮ জন সদস্যের একটি সংসার। স্বামী বিভিন্ন ধরণের কাজ করেন। ধানের মৌসুমে কৃষি শ্রমিক হিসেবে ধান রোপণ ও ধান কাটার কাজ করেন, কখনো বা রাস্তা তৈরির জন্য ইট ভাঙ্গার কাজ করে আবার যখন কোন কাজ থাকে না তখন ঝাল মুড়ি বিক্রি করেন।
বাড়িভিটা মিলে মোট ৪৮ শতাংশ জমি আছে সাগরিকাদের। এর মধ্যে পুকুর ১০ শতাংশ। ধান আবাদ করার মত কোন জমি নেই। ধান আবাদ না করায় তাকে বছরের আমন মৌসুমে সারাবছরের জন্য ধান কিনে রাখতে হয়। হিসেবে অল্প জমি অথচ এর সঠিক ব্যবহার করে সারাবছর শাকসব্জি চাষ করে তার সংসার চলে। মৌসুম ভিত্তিক একের পর এক বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি চাষ করেন। যেমন- বারোমাসি বেগুন, মরিচ, লালশাক, ডাটাশাক, পুইশাক, পাটশাক, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ঢেড়স, সীম, কেশরী আলু, মিষ্টি আলু, শিমুল আলু, করলা, মুলা, বরবটি, ঝিঙ্গা, ধুন্দল প্রভৃতি। শাকসব্জি চাষ করে শীতকালে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫০০ টাকার শাকসব্জি বিক্রি করেন। শীতকালে সবাই কম বেশি শাকসব্জি চাষ করেন তাই শীত মৌসুমে শাকসব্জির দাম কম থাকে। আর বর্ষা মৌসুমে সবার বাড়িতে শাকসব্জি থাকে না। যার ফলে তিনি বর্ষা মৌসুমে শাকসব্জি একটু বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। তখন প্রতিটি চাল চালকুমড়া বিক্রি করেন ৬০-৭০ টাকা দরে। ফলে বর্ষা মৌসুমে সপ্তাহে প্রায় ২৫০০ টাকার শাকসব্জি বিক্রি করতে পারেন বলে জানান। শাকসব্জি বিক্রি করতে তাকে তেমন কোন কষ্ট করতে হয় না। লোকজন শাকসব্জির জন্য বাড়িতে এসে কিনে নিয়ে যায়। বাড়িতে নিজেই বিক্রি করেন। আর কাছেই বাজার আছে সেখানে তার স্বামী শাকসব্জি নিয়ে বিক্রি করেন। শাকসব্জি বেশি হলে পাইকার এসে শাকসব্জি কিনে নিয়ে যায়। সব সময় একটু আগাম শাকসব্জি চাষ করার চেষ্টা করেন। আগাম শাকসব্জি চাষ করলে দাম বেশি পাওয়া যায়।
অন্যদিকে আগাম চাষ করার ফলে এক মৌসুমে ডাটা, লালশাক, মূলাশাক, পাটশাক দুই বার চাষ করা যায়।
মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ধরণের শাকসব্জি উৎপাদন করে এসব শাকসব্জি থেকে বীজও সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন সাগরিকা বেগম। যেমন লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শশা, ডাটা, পুইশাক, বেগুন প্রভৃতি শাকসব্জির বীজ নিজেই সংগ্রহ করে রাখেন তারপর রোপণের সময় হলে সময়মত রোপণ করে থাকেন। নিজের রোপণের পর অবশিষ্ট থাকা বীজ পাড়াপ্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করে থাকেন। প্রতি মৌসুমেই তিনি পাড়া প্রতিবেশীদের বীজ দিয়ে থাকেন। বীজ সংগ্রহের জন্য ফল নির্বাচন করেন যেটি সব চেয়ে ভালো, পোকা বা রোগমুক্ত সেসব ফল। তার পর সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে ভালো করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করেন। যার কারণে তার রাখা বীজগুলো অঙ্কুরোদগমনের জন্য কোন সমস্যা হয় না। নিজ হাতের বীজ রাখার সুবিধা বলতে তিনি বলেন, ‘হাতে বীজ থাকলে বাজারের উপর নির্ভর করতে হয় না, বাজারের বীজ ভালো কিনা সেটাও বোঝা যায় না ফল কেমন হবে সেটিও জানি না, কিন্তু নিজে বীজ রাখলে ফলন ও জাত কেমন হবে সেটি বোঝা যায়। মনে মধ্যে একটা বিশ্বাস থাকে।’ তিনি শাকসব্জি চাষের জন্য সাধ্যমত জৈব সার ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। গোবর দিয়ে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে তা শাকসব্জি ক্ষেতে ব্যবহার করেন। কেঁচো কম্পোস্টের গুণাগুণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘গোবর সার সরাসরি প্রয়োগ করার চেয়ে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে প্রয়োগ বা ব্যবহার করলে বেশি সুফল পাওয়া যায়।
বর্তমানে তিনি কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি করে ব্যবহারও করছেন। পাশপাশি অন্যান্যদেরকেও উৎসাহিত করছেন।
বাড়ীর চারপাশে বিভিন্ন ফলমূলের গাছ রোপণ করেছেন যেমন আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, করা, লেবু, বড়ই, নারিকেল ইত্যাদি ফল নিজে খাওয়ার পর বাকিগুলো বিক্রি করে বছরে প্রায় ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। বাাড়তে সারাবছরই একটা না হয় একটা ফল পাওয়া যায়। বারোমাসী লেবুগাছ থেকে সারাবছরই লেবু পাওয়া যায়। রোজার মাসে লেবুর চাহিদা বেশি থাকে যার ফলে লেবু বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন। সারাবছর ৩টি পেঁপে গাছ থেকে পাকা পেঁপে বিক্রি করে থাকেন। সুমিষ্ট ও ভালো জাতের পেঁপে হওয়ায় দামও ভালো পান। এবছর প্রথমবারের মত শিমুল আলু বিক্রি করেছেন ৩০ কেজি ৩০ টাকা কেজি দরে। আরো কিছু গাছ আছে সেখান থেকেও বিক্রি করা যাবে। এবছর আরো বেশি করে শিমুল আলু চাষ করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছেন।
সাগরিকা বেগম তার বাড়ীতে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর প্রভৃতি পালন করেন। বর্তমানে তার কাছে হাঁস ৬টি, মুরগি, ৫০টি, ছাগল ৫টি, গরু ২টি ও কবুতর আছে ৭ জোড়া আছে। বছরে দুইবার হাসের ডিম মুরগি দিয়ে ফুটিয়ে প্রায় ১০০টি হাঁস ৩৫০/৪০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। ৬টি হাঁস থেকে যে ডিম পাওয়া যায় এখান থেকে নিজেদের খাওয়া হয়, বিক্রিও করেন এবং কিছু ডিম ফ্রিজে জমা করে রাখা হয়। তারপর ৫০টি ডিম ৩টি মুরগি দিয়ে বসিয়ে হাঁসের বাচ্চা ফোটানো হয়। ২/৩ মাস পালনের পর হাঁসের বাচ্চা বড় হলে তা বিক্রি করে থাকেন। এভাবে ৫ বছর যাবৎ তিনি হাঁসের বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করে বিক্রি করে আয় করছেন এবছর তিনি ৯৮টি হাঁস ৩৫০-৪০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। প্রতি বছর মুরগি পালন করে নিজের চাহিদা মিটানোর পর বাকি মুরগী বিক্রি করেনও আয় করেন। এভাবে বছরে প্রায় ১৫ হাজার টাকার মুরগি বিক্রি করেন তিনি। প্রতিবছর কোরবানী ঈদের বাজারে ২টি করে খাশি বিক্রি করতে পারেন বলে জানান।
তার বাড়ির পাশে দুটি পুকুর আছে এ পুকুরে কার্পু, রুই, মির্কা, কাতল, স্বরপতি ও গ্রাসকার্পের পোনা বর্ষার মৌসুমের শুরুতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার পর বর্ষার শেষের দিকে বিক্রি করেন। তবে সারাবছরই এ পুকুর থেকেই মাছ খাওয়া হয়। বাজার থেকে মাছ কিনা হয় না। এ বছর এ দুটি পুকুর থেকে ১৯৮ কেজি মাছ বিক্রি করেছেন ১৭০ টাকা কেজি দরে। এখনো প্রায় ৫০ কেজি মাছ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন।
সাগরিকা বেগম তার ৪৮ শতাংশ জমির প্রতি ইঞ্চি মাটি সঠিকভাবে ব্যবহার করে যেভাবে সংসারে আয় করছেন সেটি অবশ্যই অনুসরণীয়, অনুকরণীয় ও প্রশংসাযোগ্য। তার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখার ও জানার আছে। যাদের অনেক জমি অথচ অনাবাদী অবস্থায় আছে তাদের জন্য শিক্ষণীয় ব্যক্তি হতে পারে সাগরিকা বেগম।