‘মানুষ আর কৃষি কামকে ভালো মনে করে না’-কৃষক ইব্রাহিম মিয়া
কৃষক মো. ইব্রাহিম মিয়া। থাকেন মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরের নয়াবাড়ি গ্রামে। দীর্ঘদিন থেকেই তিনি কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছোট্টবেলা থেকেই তিনি এলাকার কৃষির নানা পট–পরিবর্তন দেখে আসছেন। জৈব কৃষির পরিবর্তে কীভাবে এলাকায় বাণিজ্যিক কৃষি আর্বিভূত হয়েছে, কীভাবে কৃষি থেকে কৃষক বিতাড়িত হয়েছেন, কৃষকের বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণগুলো কীভাবে কোম্পানির হাতে চলে গেল এবং কীভাবে কৃষককে বীজের জন্য কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হলো–সবকিছুই তিনি স্বচোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। একসময় কৃষিতে লাভবান হতে না পারায় তিনি বিদেশেও পাড়ি দিয়েছেন জীবিকা সন্ধানের তাগিদে। কিন্তু সেখানেও খুব বেশি দিন মন বসাতে পারেননি। বিদেশ থেকে ফিরে কোথাও থিঁতু হতে না পেরে আবারও কৃষি পেশায় যুক্ত হয়েছেন। বারসিকনিউজ.কম এর সাথে আলাপচারিতায় তিনি খোলামনে তার জীবন, কৃষি এবং জৈব কৃষির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। কৃষক ইব্রাহিম মিয়ার সাথে আলাপচারিতার চুম্বক অংশগুলো বারসিকনিউজ.কম–এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মানিকগঞ্জের শিমুল কুমার বিশ্বাস।
বারসিকনিউজ.কম: কেমন আছেন? কি করছেন?
ইব্রাহিম মিয়া: ভালো আছি। কৃষিকাজ করছি।
বারসিকনিউজ.কম: পূর্বে আপনার জীবন কেমন ছিল? কিছু কি আপনার মনে পড়ে?
ইব্রাহিম মিয়া: অনেক কথাই আমার মনে পড়ে। ধলেশ্বরী নদী আমাগো বাড়ি ভেঙে নেয়। তারপর কোন রকম একটা বাড়ি বানায় আমার বাবা। আমরা ছিলাম ৭ বোন ২ ভাই। সংসারে এত অভাব ছিল যে ঠিকমত খাবার জুটতো না। অভাবের কারণে আমি ছোট কাল থেকে ধান কুড়ানো, বিড়ি বান্ধা, ইটভাটার কাম, ব্রীজের পাইলিং এর কাম করছি। অভাব দুর করার জন্য ইরাক এবং সৌদি আরবেও কাজ করেছি।
বারসিকনিউজ.কম: গত একবছরের মধ্যে আপনার জীবনের কোন ধরনের পরিবর্তন হয়েছে ? হলে কি পরিবর্তন?
ইব্রাহিম মিয়া: আমি একজন কৃষক। কৃষি কামের উপর আমার সংসার। আগে আমি জমিতে বাজার থেকে কিনে আনা সার ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন আর বাজারের সার জমিতে দেই না। আমি জৈব সার তৈয়ার করি। তা জমিতে দেই। বর্তমানে অনেক কম খরচে ফসল ফলাবার পারছি।
বারসিকনিউজ.কম: আপনি কি কি ফসল উৎপাদন করেন?
ইব্রাহিম মিয়া: আমি সাধারণত সবজি চাষ করি। যেমন ধরেন বাটিশাক, গোল আলু, বেগুন, বিলাতি ধনে, কালিজিরা, পিঁয়াজ রসুন, মুলা, মিষ্টি আলু, লাউ, সীম,বরবটি, কপি, পেপে,কোয়শ।
বারসিকনিউজ.কম: আগের কৃষি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
ইব্রাহি মিয়া: কৃষি কাজে বর্তমানে খরচ বেড়ে গেছে। কারণ এখন কৃষি আর কৃষকের কাছে নাই। সবই বাজার থেকে কিনতে হয়। যেমন: সার, ঔষধ, বীজ, হাল চাষ সবই কিনতে হয়। আগে প্রতি বাড়িতে গরু থাকত, গরুর গোবর মাঠে দেওয়া হতো, ধানের নাড়া (ধানের খড়) হতো, প্রত্যেক বছর মাঠে পানি আসতো। আমাদের ধলেশ্বরী নদীতে ৮০ হাত পানি থাকত। নদী ছিল এক মাইল চওড়া। নদীতে অনেক ইলিশ মাছ ধরা পড়তো। প্রতিবছর বর্ষার পানি আসার কারণে মাঠে পলি পড়তো। তাতে সার হতো। এছাড়া অনেক ধরনের ধান জাত ছিল। যেমন: ভাওয়াল্য, হরহরা, নেজাবরন, শামু ভাংগা, দিঘা, হলদে পাতা, মুক্তাশ্বর, দুধ ভাওয়াল্যা, বরণ, পুরপিুর, মরিচিফুল, কালা মানিক, পরাংগি, কৈজুরী বাওইঝাক, বাইশমুরালি শাইট্টা।
বারসিকনিউজ.কম: এই যে পরিবর্তন এর কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
ইব্রাহিম মিয়া: এখন মানুষ আর কৃষি কাম ভালো মনে করে না। সবাই চাকরি খোজে। তাছাড়া আগের মত পানিও হয় না। খাল, নদী নালা, মাঠ ঘাট ভরে গেছে। পানি হয় না তাই আগের দিনের ধানের জাতও নাই।
বারসিকনিউজ.কম: এখন আপনার সংসারের অবস্থা কেমন মনে করেন? কেন তা মনে করছেন?
ইব্রাহিম মিয়া: এখন আমার সংসারে কোন অভাব নাই। আমি বিদেশে যাওয়ার পর যে টাকা কামাই করেছি তা দিয়ে জমি কিনেছি। বর্তমানে সেই জমি চাষ করি। তা দিয়েই আমার সংসার চলে যায়। তাছাড়া এক ছেলে মিস্ত্রি কাম করে। ছোট ছেলে এই বছরে আর্মির চাকরি পাইছে।
বারসিকনিউজ.কম: এই যে আপনি বললে যে আপনার কৃষিকাজে বাজারের সার ব্যবহার করেন না, তাহলে এর জন্য আপনি কি কি উদ্যোগ গ্রহন করেছেন?
ইব্রাহিম মিয়া : শোনে..ন। আমি দেখলাম যে ফসল ফলাই তার সব টাকা যায় সার, বীজ, ঔষধ কেনার বাবদ। তাই আমি প্রায় ৮/৯ বছর ধরে জমিতে কিছু কিছু জৈব সার দেওয়া শুরু করি। পরে বারসিক আমারে কেচো সার বানানো শেখায়। এখন আমি আর বাজারের সার কিনি না। আমি দুইডা হাউজ বানাইছি। সেখানে কেঁচো সার তৈরি করি এবং জমিতে দেই। তাছাড়া আমি গাছের পাতা, পাটের দানা দিয়ে পোকা মাড়ার ঔষধ তৈয়ার করে ফসলে ছিটাই। বীজ তো আমি বাজারের থেকে কিনি না, বাড়িতে রাখি। তাতে আমার অনেক উপকার হয়।
বারসিকনিউজ.কম: এই যে সার ছাড়া সবজি উৎপাদন করেন তাতে কিভাবে লাভ বেশি হয় বলে মনে করেন?
ইব্রাহিম মিয়া: আমার সবজির কদর বেশি। আমার কাছ থেকে একবার যে সবজি কিনে, সে আবার আমারে খোঁজে। অনেকসময় বাজার পর্যন্ত যাবার পারি না। পথ থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। স্বাদ পায় বেশি। টাকাও বেশি পাই।
বারসিকনিউজ.কম: এই যে আপনার বাড়িতে এ ধরনের গাছ দেখছি এগুলো কিভাবে যোগার করলেন? কেনই বা যোগার করলেন? কোন ধরনের গাছ বেশি আছে ?
ইব্রাহিম মিয়া: গাছ লাগানো আমার সখ। আমি বেশির ভাগ সময় পায়ে হেটে বিভিন্ন যায়গায় যাই। পথে হাটতে হাটতে কোন গাছ পেলে আমি নিয়ে আসি। গাছলাগাতে আমার ভালো লাগে। আমার বাড়িতে ঔষধি গাছগুলো বেশি। ফলের গাছও আছে অনেক। কাঠ গাছ বেশি লাগাই না। গাছ গাছ শুধু কাঠ হয়। আর ফল গাছে দুইটাই পাওয়া যায়।
বারসিকনিউজ.কম: আগে এই এলাকায় গাছের পরিমাণ কেমন ছিল? বেড়েছে না কমেছে?
ইব্রাহিম মিয়া: আগে এই এলাকায় অনেক ধরনের গাছ ছিল। তয় এখন আর তেমন নাই। আগে তো বাগান ছিল অনেক। মানুষ বেশি গাছ লাগায় না। যা লাগায় তা বাড়ির উপর। তাতে কয়ডা গাছ লাগানো যায়। গাছ লাগানোর মত জায়গা নাই।
বারসিকনিউজ.কম: আপনি যে বললেন আপনার বাড়িতে অনেক ধরনের ফলের গাছ এবং ঔষধি গাছ আছে সেগুলো কি কি?
ইব্রাহিম মিয়া: আমার বাড়িতে ফলের গাছের মধ্যে আছে আম, কাঁঠাল, সুপারি, নারিকের, লেবু, আমলকি, জাম্বুরা, আমড়া, ছবেদা, কমলা, পেয়ারা, বড়ই, অরবড়ই, জামরুল, পিচফল, ডৌয়া, কামরাংগা, বেদানা, মেওয়াফল, লটকন, কদবেল, চালতা, বিলাতি গাব, জলপাই। আর ঔষধি গাছের মধ্যে আছে উলট কমল, ঘৃতকমল, মুরমুরে, কল্পনাথ, গোড়া চক্কর, রাধা চক্কর, সাদা লজ্জাপতি, মনিরাজ, পাথর চুনা, মানরাজ, শতমুল, বাসক, রামতুলশি, কাল তুলশি, বায়না, ইশ্বর মুল, তুলশি, জৈষ্ঠমধু, টাকা থানকুন, ভুইকুমরা, তুরুক চন্ডাল, বিষজারুল ইত্যাদি।
বারসিকনিউজ.কম: এত যে সব ঔষধি গাছ, তা কি আপনার কোন কাজে লাগে? কিকি রোগের চিকিৎসা করেন?
ইব্রাহিম মিয়া: ঔষধি গাছ আমার অনেক কাজে লাগে। কারণ ঔষধি গাছ ব্যবহার করে আমি অনেক মানুষের রোগ সাড়াই। আমি গাছ ব্যবহার করে জন্ডিস, আমাশয়, গরুর রোগ, বাউসি, পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, রাতকানা, মাজার ব্যাথা, শ্বাস কষ্ট, ফোঁড়া, শাপের নামানো, কুকুরের কামড় এর চিকিৎসা করি। মানুষের এত যে রোগ বেড়েছে তার কারণ হিসারে রাসয়নিক সারের খাবার। আমি চিকিৎসা দিয়ে কোন টাকা পয়সা নেই না। আমার বাড়িতে ভেউরা ভাসানো অনুষ্ঠান (ভাদ্র মাসে) হয় সেখানে অনেক ভক্তরা চালডাল নিয়ে আসে এই যা।
বারসিকনিউজ.কম: কার কাছ থেকে এই চিকিৎসা করা শিখলেন?
ইব্রাহিম মিয়া: আমি আমার দাদা এবং বাবার কাছ থেকে শিখেছি।
বারসিকনিউজ.কম: আপনার জীবনের কোন স্মরণীয় বা আবেগময় কোন ঘটনা আছে? যদি বলেন!
ইব্রাহিম মিয়া: আমার জীবনের সবচে’ স্মরণীয় ঘটনা একটাই। তা হলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে মুক্তি যোদ্ধাদের তালিকায় আমার নাম ওঠেনি। আমি যখন যশোহরে ইটভাটার কাজ করি, তখন যুদ্ধ শুরু হয়। তখন আমার বয়স ২৬ বছর। আমি যুদ্ধে নেমে পড়ি। ঝিকোরগাছা থেকে ৩ দিন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। প্রথম যশোহর জেলাখানা ভাঙ্গি। কয়েদী খালাস করে আমাগো দলে নেই। এরপর যশোহর নিউমার্কেট, বিহারী কলোনী, নীলগঞ্জ বিহারী ক্যাম্প আক্রমণ করি। পড়ে ভাটিয়াপাড়া হয়ে মানিকগঞ্জের বাল্লা বাজারে মুক্তি বাহিনী দলের সাথে যোগ দেই। যুদ্ধের পর কয়েকবার তালিকায় নাম লেখানোর জন্য আবেদন করি। প্রতিবারই আমার কাছে টাকা চায়। তখন আমার কাছে কোন টাকা নাই। তালিকায়ও নাম উঠলো না। এরপর ইরাকে গেলাম। সেখানে একটা মেসে থাকতাম। একদিন আগুন লাগলো, আমার যুদ্ধের সার্টিফিকেটটি আগুনে পুড়ে গেল। জীবনের একটাই দুঃখ মুক্তিযুদ্ধ করেও যোদ্ধা হবার পারলাম না!
বারসিকনিউজ.কম: আপনি যেসব কাজ করেছেন তা কেউ দেখতে আসে না? কারো কাছ থেকে কি কোন কিছু পেয়েছেন যা আপনাকে এই কাজটা করতে আপনাকে আরো উৎসাহ দেয়?
ইব্রাহিম মিয়া: আসলে আমি কোন কিছু পাওয়ার জন্য এ কাম করি না। তয় কেউ আসলে আমার ভালো লাগে। এর মধ্যে গ্রামের অনেকে আমার কাম দেখেছে। তারা এ ধরনের কাম শুরু করবার চাইছে।
বারসিকনিউজ.কম: আপনার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা বা স্বপ্ন কি?
ইব্রাহিম মিয়া: আমার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা বা স্বপ্ন হলো এলাকার মানুষকে নিরাপদ খাদ্য খাওয়ানো এবং ভালো রাখা।