দেশীয় জাতের ধানও ভালো ফলন দেয়
উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার সফল কৃষক ও সংগঠক সিরাজুল ইসলাম। উপকূলীয় এলাকার লবণ মাটিতে চাষাবাস করার জন্য তিনি স্থানীয় জাত থেকে লবণসহনশীল বেশ কিছু ধান উদ্ভাবন করেছেন জাত গবেষণার মাধ্যমে। এছাড়া তিনিসহ এলাকার বেশ কিছু কৃষক স্থানীয় জাতের ধান সংরক্ষণ করছেন। তাদের সংগ্রহে বর্তমানে বেশ কয়েকটি উৎপাদনশীল, লবণ ও জলাবদ্ধতা সহনশীল স্থানীয় জাতের ধান রয়েছে। কৃষক ও সংগঠক সিরাজুল ইসলামের কৃষিকাজ, জাত গবেষণা, স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চাসহ তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় জানার জন্য বারসিকনিউজকে এই বিশেষ সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন!
বারসিকনিউজ: কবে থেকে আপনি কৃষি কাজ করেন? লোকায়ত ও স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চা সম্পর্কে কিছু বলুন?
সিরাজুল: ছোটবেলায় যখন আমার বয়স ৩/৪ আমার আব্বা বাড়ির পাশে প্রতিবছর ধানের বীজতলা করতেন। এ সময় বাবুই ও চড়–ই পাখি বীজতলা থেকে ধান খেয়ে ফেলতো। পা দিয়ে পুতে দিতো। তখন আব্বা বাজারে যাওয়ার সময় আমাকে চোকি দেওয়ার জন্য রেখে যেতো। আমি থালা-টিন বাজিয়ে পাখি তাড়াতাম। সেই থেকে পড়াশুনার পাশাপাশি আব্বার সাথে কৃষি কাজ করতাম। আব্বা ফসল চাষে গোবর সার ও কচুরি ব্যবহার করতো। সার ও কীটনাশক এলাকার কোন কৃষক ব্যবহার করতো না। ১৯৮৯ সালে আমি সরকারিভাবে আইপিএম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এ সময় রাসায়নিক কৃষির ভয়াবহতা বিষয়ে অনেক বেশি জানতে পারি এবং জৈব উপায়ে সফল চাষ করার প্রশিক্ষণ পাই। তখন বুঝলাম বিষ ভবিষ্যতে আমাদের বড় ক্ষতি করবে। সেই থেকে কোন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈব উপায়ে বিভিন্ন ফসল নিজে চাষ করা শুরু করি এবং অন্যদেরও প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেই। এটাই আমাদের টেকসই কৃষি।
বারসিকনিউজ:স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চার বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনি দেশীয় ধান জাতের ওপর গবেষণা করছেন। এই সম্পর্কে কিছু বলবেন? কিভাবে আপনি এটা শুরু করেছেন? কোন ধরনের ধান জাত আপনার সংগ্রহে আছে? সেসব ধানের গুণাবলী কি?
সিরাজুল: এলাকায় এক সময় স্থানীয় অনেক ধানের জাত ছিল। ঐ সমস্ত ধান ঝড়-বন্যা-লবণাক্ততা সহ্য করে টিকে থাকতো। বাপ-চাচাদের ওই সব ধান চাষ করতে দেখতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে স্থানীয় ধানের জাতগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে আমার চিন্তা হলো-আগের ধানের জাতগুলো সংগ্রহ করে নিজেরা পরীক্ষা করে দেখলে অনেক ধান জাত আমাদের বর্তমান লবণাক্ত পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে। এরপর ২০০৫ সালে বারসিক শ্যামনগর অফিসে যোগাযোগ করে কর্মকর্তাদের সাথে আমার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরি। ২০০৬ সাল থেকে স্থানীয় ধান জাতের নির্বাচনের কাজ শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করি। বারসিকের সহযোগিতায় ওই বছর ৩৪টি ধানের জাত সংগ্রহ করে পরীক্ষণ প্লট করি নিজের জমিতে। সেই থেকে শুরু এবং বর্তমানে আমাদের কাছে আমনে ৬৩টি প্রকার স্থানীয় ধানের জাত আছে। লবণ সহ্য করে টিকে থাকতে পারে পাটনাই, তালমুগুর, কুটেপাটনাই, জটাইবালাম, দারশাইল, চিনিকানি, তেইশবালা, ইঞ্চি, কাজলশাইল, বয়ারবট। জলবদ্ধতা সহনশীল মালাগেতি, কুমড়াগৌড়, কাচড়া, মহিনি সালট, রানী সালটসহ ৭৬টি ধানেরও জাত আছে। পুষ্টি ও স্বাদ বেশি।
বারসিকনিউজ: এ পর্যন্ত কয়টি দেশীয় জাত নিয়ে গবেষণা করেছেন? কোন কোন জাতটি আপনার উপকূলীয় এলাকার মাটি, পরিবেশ ও আবহাওয়ার সাথে মানানসই ও উৎপাদনশীল? এ পর্যন্ত কয়টি জাত আপনার সংরক্ষণে আছে?
সিরাজুল: ২০০৬ সালে ৩৪টি জাত নিয়ে শুরু করি। পর্যায়ক্রমে ২০০৭ সালে ৩৬টি, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে ৩৯টি, ২০১০ সালে ৬০টি, ২০১১ সালে ৯৩টি, ২০১২ সালে ৭৬টি এবং ২০১৩ সালে ৬৩টি স্থানীয় ধান জাত নিয়ে গবেষণা করে চলমান আছে। আমাদের এলাকায় লবণাক্ততা সহ্য করে টিকে থাকতে পারে পাটনাই, তালমুগুর, কুটেপাটনাই, জটাইবালাম, দারশাইল,চিনিকানি,তেইশবালা, ইঞ্চি, কাজলশাইল, বয়ারবট। জলবদ্ধতা সহনশীল মালাগেতি, কুমড়াগৌড়, কাচড়া, মহিনি সালট, রানী সালটসহ ৭৬টি ধানেরও জাত আছে।
বারসিকনিউজ:এলাকার কৃষকরা আপনার এই কাজে কতটা সহযোগিতা করছে? কতজন কৃষক আপনার সাথে এ কাজ করছে?
সিরাজুল: আমার সমমনা কৃষকেরা স্থানীয় ধানের জাত নির্বাচনে জমি নির্বাচন, চাষ, বীজতলা তৈরি, রোয়া, কাটা-মাড়াই-ঝাড়াই ও সংরক্ষণের প্রতিটি পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে সহযোগিতা করেছে। কৃষক-কৃষাণী আমার এ কৃষি কাজ চলমান রাখতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছে। বর্তমানে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে প্রায় ৪শ’ কৃষক নিজেরা স্থানীয় ধান জাত আমার কাছ থেকে নিয়ে চাষ করছে।
বারসিকনিউজ: আপনার এই উদ্যোগের সফলতায় অন্য কৃষকেরা কি উৎসাহিত হয়েছে স্থায়িত্বশীল কৃষিচর্চায়? আপনি কীভাবে তাদের সহযোগিতা করেন?
সিরাজুল: অবশ্যই। সার-কীটনাশক ব্যবহার করতে করতে সকল কৃষকেরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার কাজ দেখে মানুষ থমকে দাঁড়ায় এবং আগের আমলের কৃষির চিন্তা-ভাবনা আবার শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষ আমার কাছ থেকে তাদের পছন্দের জাত সংগ্রহ করে চাষাবাদ শুরু করেন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে থাকে। আমি আগ্রহী কৃষকদের বিনামূল্যে তাদের পছন্দের বীজ, পারস্পরিক বীজ বিনিময়, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সেবা দিয়ে সহযোগিতা করি।
বারসিকনিউজ: কেউ কি আপনার কাছে স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চাসহ অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা ও পরামর্শ নিতে আসে? মূলত কারা আপনার কাছে আসে?
সিরাজুল: অবশ্যই আসে। প্রতিদিন অনেক কৃষক-কৃষাণী আমার সংগঠনে এসে আমার কাছ থেকে জৈব কৃষি চর্চার পরামর্শ নিয়ে আসে। কিভাবে বন্ধু ও শত্রু পোকা চিনতে হয়। বন্ধু পোকার উপকারিতা অনেক। সারা পৃথিবীতে ৩৪ হাজার বন্ধু পোকা এবং ৫ হাজার শত্রু পোকা আছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করাতে বন্ধু পোকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমি কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয় যে, নিজের কাছে বীজ রাখ, জৈব কীটনাশক ও সার ব্যবহার কর। মূলত একটু বয়স্ক কৃষক ও বিভিন্ন এনজিওর প্রতিনিধিরা আমার কাছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-পরামর্শ গ্রহণ করতে আসেন। উপজেলার প্রায় ৪০টি কৃষক সংগঠনের সদস্যদের আমি এই প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়েছি।
বারসিকনিউজ: অনেকে বলেছেন দেশীয় জাতে আবাদ করলে ফলন কম হয়-এই ব্যাপারে আপনার অভিমত ও অভিজ্ঞতা কি আপনাদের সাথে সহভাগিতা করবেন?
সিরাজুল: সব স্থানীয় ধান জাতের ফসল কম না। অনেক স্থানীয় জাতের ফলন বেশি হয়। যেমন-দারশাইল, পাটনাই, তালমুগুর, খেজুরছড়ি, কুটেপাটনাই, জটাইবালাম ইত্যাদি জাতের ফলন বেশি। উফশি ও হাইব্রিড ধান চাষ ও স্থানীয় ধান চাষের খরচের তুলনা করলে দেখা যায় স্থানীয় ধান চাষ করা লাভজনক। তাছাড়া, স্থানীয় ধান চাষে কৃষক আত্মনির্ভরশীল হয় ও পরিবেশ ভালো থাকে।
বারসিকনিউজ: আপনি একজন সফল সংগঠকও বটে! কৃষকদের সাথে এবং এলাকার অন্যান্য পেশাজীবীদের নিয়ে সংগঠন তৈরিতে আপনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আপনি কেন মনে করেন এসব সংগঠন প্রয়োজন? এসব সংগঠন কীভাবে পরিচালনা করেন? এসব সংগঠনের কর্মসূচি কি কি? কারা এসব সংগঠনের সদস্য?
সিরাজুল: একা কোন কাজ করা সম্ভব না। সংগঠিত হয়ে কাজ করলে আরো দ্রুত কাজটি প্রসারিত হবে। প্রতিটি সংগঠনের কমিটি তৈরি, কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বিভিন্ন কৃষি কাজ করার জন্য পরামর্শ দেয়। এছাড়া, প্রতিমাসে ও তিন মাসে সমন্বয় সভা করে সকল সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে মতবিনিময় করি। এরপর যে সকল সংগঠন একটু পিছিয়ে তাদেরকে কাজে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেয়। এ সব সংগঠনগুলো কৃষি, বনায়ন, বীজ সংরক্ষণ, মাটি-পানি পরীক্ষা, সামাজিক সচেতনতা তৈরি, পারস্পরিক জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের কাজ করে। পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন কৃষি চর্চা কর্মসুচী বাস্তবায়ন করেন। এলাকার কৃষক-কৃষাণী-বনজীবী-আদিবাসী-হস্তশিল্পসহ সব পেশার নারী/পুরুষ এ সকল সংগঠনের সদস্য।
বারসিকনিউজ: কৃষিতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে আপনি কখনও কোন সম্মাননা বা পুরুষ্কার পেয়েছেন?
সিরাজুল: হ্যাঁ, চ্যানেল আই থেকে ২০১২ সালে চ্যানেল আই কৃষি পদক পেয়েছিলাম। এছাড়াও গ্রামীণ জীবনযাত্রা মেলায় দু’বার, মাঠ প্রশিক্ষণে সেরা কৃষক নির্বাচিত হওয়ায় ৮টি পুরুস্কার এবং প্রাণবৈচিত্র্য সন্মাননা পেয়েছি।
বারসিকনিউজ: আপনাকে যদি বলা হয়,বাংলাদেশের কৃষক ও নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্য তাহলে আপনি তাদের কি বলবেন?
সিরাজুল: আমাদের টেকসই কৃষি চর্চার সকল প্রযুক্তি, জ্ঞান-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা ও ফসলের জাত সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে। তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সম্পদ, কৃষি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে। অন্যদিকে সারা বাংলাদেশের কৃষকদের উদ্দেশ্যে আমি একটাই কথা বলবো যে, আপনারা গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠন তৈরি করে এলাকার কৃষি-বীজ-মাটি-পরিবেশ সংরক্ষণ করুন। নিজেদের সম্পদে নিজেদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করুন।
বারসিকনিউজ: আপনাকে ধন্যবাদ
সিরাজুল: ধন্যবাদ।