“ছেউ জাউন”বরেন্দ্রর কৃষক উদ্ভাবিত নিজস্ব সেচ পদ্ধতি

“ছেউ জাউন”বরেন্দ্রর কৃষক উদ্ভাবিত নিজস্ব সেচ পদ্ধতি

বরেন্দ্র অঞ্চল তানোর থেকে অমৃত সরকার

বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূমির গঠন ভৌগলিকভাবেই দেশের অনান্য কৃষি প্রতিবেশ এলাকার থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। এই অঞ্চলের অধিকাংশ ভূমির গঠনই উঁচু নিচু। ইংরেজিতে এ ধরনের ভূমিকে বলা হয় “ট্যারেস ল্যান্ড”। এই ধরনের জমিগুলো একটি থেকে অন্যটির উঁচ্চতা ছয় ইঞ্চি থেকে বারো ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর উঁচু নিচু হওয়ার কারণেই যে কোন ধরনের ফসলে সেচের জন্য দেখা দেয় সমস্যা। যার মধ্য পানির ড্রেন নির্মাণ, ড্রেনের স্থায়িত্ব, পানির অপচয়, পানির প্রাপ্যতা অন্যতম। মূলত এ সমস্যা বিবেচনা করেই বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা নিজেরাই সেচ কাজের জন্য উদ্ভাবন করেছেন নতুন একটি পদ্ধতি যার নাম কৃষকরা দিয়েছেন “ছেউ জাউন” পদ্ধতি। বরেন্দ্র অঞ্চলে বৃষ্টিনির্ভর আমন ব্যাতিত সকল ফসলের মাঠেই প্রয়োগ করতে হয় সম্পূরক সেচ। নলকূপ থেকে ফসলের জমির দূরত্ব কম হলেও ভূমির গঠন উঁচু নিচু হওয়ার কারণে নালা দিয়ে পানি আসতে অনেক সময় লেগে যায়। সেক্ষেত্রে পানির অপচয় হয় বলে সেচ কাজে খরচ বেড়ে যায়, নালা উঁচু নিচু বলে পানি প্রবাহের কারণে প্রতিবছরেই ড্রেন ভেঙ্গে যায়, ড্রেন নির্মাণে হয় বাড়তি খরচ হয়। আবার সেচের কারণে ভূমি ক্ষয় চরম মাত্রায় পৌছায়। আর এ থেকে কৃষকদের মাঝে শুরু হয় বিবাদ। তবে কৃষকদের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে এ সমস্যা দেখা দেয় না।

20180314_110037

পানির প্রাপ্যতা, একসেচ থেকে আরেক সেচের মধ্যবর্তী সময়, ভূমি ক্ষয় ও সেচজনিত খরচ বিবেচনা করে কৃষকরা নিজেদের মধ্য আলোচনা ও সমন্বয় করে ফসলের জমিকেই সেচ নালা হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিকেই কৃষকরা নাম দিয়েছেন “ছেউ জাউন”পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে এক জমি থেকে অন্য জমি নিচু হওয়ায় সেচ কাজ শুরু হয় উঁচু জমি থেকে। এভাবে পর্যায়ক্রমে নিচু জমিতে সেচ কাজ আগে সম্পন্ন হয়। এরপর আস্তে আস্তে সকল জমিই সেচের পানি দ্বারা পূর্ণ হয়। দুইটি জমির মধ্যবর্তী আইলে পলিথিন ব্যবহার করে নালা তৈরি করা হয়। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার বরশিপাড়া গ্রামের কৃষক মো. বাচ্চু মিয়া (৪৫) বলেন, “আমাদের এলাকায় সেচের প্রধান সমস্যা হলো সঠিক সময়ে আমরা সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য পানি পাই না। আবার জমি উঁচু নিচুর কারণে পানি সেচের কারণে মাটি ক্ষয় হয়ে জমির আইল ভেঙ্গে যায়। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা পাশের জমির মালিকদের সাথে আলোচনা করে এই পদ্ধতিতে সেচ কাজ পরিচালনা করছি।” তিনি আরও বলেন, “ছেউ জাউন পদ্ধতিতে সেচ কাজ পরিচালনার ফলে ফসল চাষীর জমিতে সঠিক সময়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হচ্ছে, নিশ্চিত হচ্ছে ভূমি ক্ষয় রোধ। পাশাপাশি রোধ হচ্ছে পানির অপচয়।”

20180314_110133

এ বিষয়ে একই উপজেলার বটতলী গ্রামের কৃষক মো. আনোয়ার হোসেন(৪৮) বলেন, “আমাদের এলাকায় বিশেষ করে বোরো ধানের ক্ষেত্রে জমি ভেদে সাত থেকে দশটি সেচের প্রয়োজন পরে। আমরা যখন থেকে “ছেউ জাউন” পদ্ধতি ব্যবহার করছি তখন থেকে প্রতিবছরই বোরো ধানের ক্ষেত্রে এক থেকে দুইটি সেচ কম লাগছে। যা আমাদের এলাকার জন্য খুবই উপযোগি।” একই গ্রামের বিএমডিএ গভীর নলকূপের পরিচালনায় থাকা ডিপ চালক মো. আসরাফুল আলম (৪২) বলেন, “সাধারণত এক বিঘা জমিতে বোরো মৌসুমে পানি দ্বারা পূর্ণ করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু কৃষকরা যখন “ছেউ জাউন” পদ্ধতির ব্যবহার করছেন তখন দেখা যাচ্ছে দুই বিঘা জমি চার থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যেই পানি দ্বারা পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তা থেকে যেমন বিদ্যুৎ খরচ রক্ষা পাচ্ছে, তেমনি রক্ষা পাচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় ভূগর্ভস্থ পানি। যা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের জন্য খুবই উপযোগী।”

20180314_110140

বাংলাদেশের প্রতিটা কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষকরাই নিজেদের কাজের মাধ্যমেই সৃষ্টি করেন স্থায়িত্বশীল ও এলাকা উপযোগি কিছু উদাহরণ। বরেন্দ্র অঞ্চলের “ছেউ জাউন” পদ্ধতিতে সেচ তেমনই একটি উদাহরণ। যা বর্তমান সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে। আর এ থেকেই গোদাগাড়ি অঞ্চলের কৃষকরা মনে করছেন এই পদ্ধতিটি যদি বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলের সকল কৃষকই নিজের জমিতে প্রয়োগ করেন তাহলে ভবিষ্যতে বরেন্দ্র এলাকায় আর পানির সমস্যা থাকবে না।

happy wheels 2

Comments