আমার উডানডা (উঠোন) সবুজে ভরা …
তাজমহল আক্তার। বাস করেন নেত্রকোনার লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের দরুন হাসামপুর গ্রামে। তিনি দীর্ঘদিন স্থায়িত্বশীল কৃষি চর্চা করে আসছেন। কৃষিকাজ করে তিনি সফলতার সাথে তার পরিবার পরিচালনা করেছেন। এছাড়া পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি পরিবেশ, প্রাণ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। তার এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত একটি নাম। তিনি আলোচনায় তার জীবনের নানান সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন বারসিকনিউজ এর কাছে। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছে বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের কর্মকর্তা হেপী রায়
বারসিনিউজ: কেমন আছেন?
তাজমহল: বালা আছি। আফনে কেমন?
বারসিকনিউজ: ভালো। আপনার বাড়িতে কে কে আছে?
তাজমহল: আমার এক ছেলে আর দুই মেয়ে।
বারসিকনিউজ: স্বামী কি কাজ করেন?
তাজমহল: আগে গিরস্তি (কৃষি) (কাম (কাজ) করতো। অহন ফিশারীত কাম করে।
বারসিকনিউজ: আপনি কি করেন?
তাজমহল: আমি বাড়ির কামকাজ করি। বাড়িতে গিরস্তি করি। পোলাপানের দেখশোনা করি।
বারসিকনিউজ: আপনি গিরস্তি কাজ করেন?
তাজমহল: ক্যারে? ফসকৃষি লাগাই। মুরগামুরগী পালি। গরু, ছাগলও আছে। এইতা গিরস্তি না?
বারসিকনিউজ: কিভাবে শুরু করলেন এই কাজ?
তাজমহল: আমার মাডের জমিন (কৃষিজমি) নাই। বাড়ি ভিডার জাগাও (জায়গা)কম। আমার স্বামী মাইনষের জমিনে কামলা দেয়। এই কামও পত্যেকদিন পায়না। যেদিন কামে যায়, খাওন চলে। আস্তে আস্তে সংসার বড় অইছে। কামলা দিয়া যা পায়, তা দিয়া তো চাইর (চার) জনের সংসার চলেনা। মাঝে মইধ্যে ঋণ করন লাগে। সংসারে সবসময় অভাব লাইগ্যা থাহে। এইভাবে যহন আর চলতাছিল না, তহন চিন্তা করলাম নিজেরই কিছু করন লাগবো।
আমরার গ্রামের অনেকেই বাইরে গিয়া কাম করে। লেহাপড়া জানিনা। চাকরি তো পাইতামনা। অনেক চিন্তা কইরা ৩/৪ বছর আগে পোলাপান থইয়া একবার গার্মেন্স এ গেছিলাম। কিন্তু হেই জাগায় গিয়াও শান্তি নাই। পোলাপান রাইখ্যা গেছি, মাইনষের উপরে। মন টিকেনা, পোলাপানও থাকতে পারেনা। এছাড়া যা কামাই করি, তারচে’ খরচ বেশি। কয়েক মাস থাইক্যা বাড়িত আইছি।
বারসিকনিউজ: তারপর কি করলেন?
তাজমহল: বাড়িত আসার পর স্বামী আবার কামে লাগলো। আর আমি বাড়ির কামকাজই করতে থাকলাম। স্বামীর কামাইয়ের (উপার্জন) ট্যাহা দিয়া চাউল, তেল, লবণ কিনলেই শেষ। তরিতরকারী কিনা যায় না। ভাতের লগে তো অন্য কিছুও লাগে। কয়দিন কিইন্যা খাওন যায়?
যতদিন ঢাহা (ঢাকা) আছিলাম, ঘরবাড়ি খালি পইরা আচাইল্যা (আগাছা) গাছগাছালিতে ভইরা গেছিল। আস্তে আস্তে এইগুলা পরিষ্কার করতে লাগলাম। পরিষ‹ার কইরা কোণায় কানায় কয়েকটা আলি(বীজ) খোসা (পুঁতে) দিয়া রাখছিলাম। ভাবলাম যদি কোনো গাছটাছ উডে, এইডা দিয়া তো পোলাপান লইয়া খাওনডা চলবো।
বারসিকনিউজ: বীজ পেলেন কোথায়?
তাজমহল: আমরার বাড়ির আশপাশের অনেকেই ফসকৃষি করে। তারার কাছে থেইক্যা আনছি। লাউ, উস্যি, করলা লাগায়া শুরু করলাম। কয়দিন পরে দেহি গাছ উঠছে। সব্জীও ধরছে। কয়ডা কইরা তুলি, আর রান্ধি।
বারসিকনিউজ: সব্জী চাষের পাশাপাশি আর কি কি করেন?
তাজমহল: আমরার গ্রামের একজনরে কইলাম একটা গরু কিইন্যা দিতো। আমি পালবাম। বাছুর অইলে, বেচলে কিছু ট্যাহা পাওয়া যাইবো। আর আমার স্বামীরে কইছি, দুইডা মুরগামুরগী কিনতো। এইডির ডিম দিয়া, বাচ্চা ফুডায়া বাড়ানি (বৃদ্ধি) যাইবো। এইভাবেই সংসারডা চালাইতে অইবো।
প্রথমবার গাছে সব্জী অইছে, খাইছি। বেচতে পারছিনা। এইতা দেইখ্যা রংরং লাগছে। ভাবছি আরো মাড়াইতে (চাষ করা) পারবাম। যদি বেশি অয়, বেচলে কয়ডা ট্যাহাও পায়াম, খাওনডাও চলবো। যে ফসকৃষি মাড়াইছিলাম, হেইডির আলি রাখছি। অন্য জাতের কিছু আলি বাজারতে কিনছি। কোনো হানে বেড়াইতে গেছি, নতুন কিছু দেইখ্যা হেনতেও আলি চায়া আনছি। পুস্কুনির পাড়ে, ধাইড়ে, উডানের এক কিনারে লাগায়া দিছি। যাতে গাছ অয়।
একজনের কাছ থেইক্যা যে গরু আনছিলাম, হেইডারেও যত্ন কইরা পালতে লাগলাম। রান্ধাবাড়ার সময় বাদ দিয়া সারাদিন ফসকৃষির তালাবি (যত্ন), গরুর ঘাস কাডা, সবতাই করি। আস্তে আস্তে ফসকৃষি বাড়ছে। আস (হাঁস) মুরগামুরগীও কিনছি।
আমার বইনের বাড়ি থেইক্যা কালা মরিচের চারা আনছি। এইতা গাছ দুইডা থাকলেই সারাবছর চলে। কাঁচা মরিচ কিনন লাগেনা। মামীর (প্রতিবেশি) বাড়িত্তে বারোমাসী লেবু, আ-া বাইগুনের চারা আইন্যা লাগাইছি। যাতে সারা বছর খাওন যায়। বাড়ির জাগা কম, বেশি গাছ লাগাইলে অন্যতা করন যাইতো না। চিন্তা কইরা দেখলাম, বাড়ি ছাইরা যহন আর যাইতামনা, এইতাই করি।
আমরার গ্রামে ঘুইরা ঘুইরা অহন আসের (হাঁসের) বাচ্চা বিহি (বিক্রি) অয়। একজনের কাছ তে ট্যাহা কজ্জা (ধার) কইরা ৬ডা আসের বাচ্চা কিনছিলাম। এংচি পাতা, শামুক, খুঁদকুঁড়া খাওয়ায়া পালছি। বড় অইছে, ডিম দিছে। পোলাপানরে ডিম খাওয়াইছি, বেচছি। দুই আলি ডিমের বাচ্চা তুলছি। বড় আস বেইচ্চা বালা(ভালো) লাভ অইছে। পরে এই ট্যাহা দিয়া কয়ডা মুরগী কিনছি।
বারসিকনিউজ: সব্জি বিক্রি করতে পারেন?
তাজমহল: অহন পারি। আগে পারতামনা। যা অইতো খালি খাওন চলতো। অহনতো উডানের মইধ্যে খালি হাটাচলার জাগা রাইখ্যা সবটার মইধ্যেই ফসকৃষি লাগায়া দিছি। আমার উডানডা সবুজে ভরা। খালি সব্জি না পাবদা (পেঁপে), জলপই, বড়ই, আম, কাডল, কলা, সুপারি বেকতাই আছে। এইডিও বেচি।
বারসিকনিউজ: কোথায় বিক্রি করেন? বাজারে নিয়ে যান?
তাজমহল: না, বাজারে নেওন লাগেনা। আল্লায় দিলে বাড়িত্তেই বেচন যায়। আমার বাড়িত সবতা আছে দেইখ্যা যার যে সময় যেডা লাগে, বাড়িত্তেই কিইন্যা লইয়া যায়। আর আমার স্বামী তো এহন বাড়িত নাই। অন্য জায়গায় ফিশারীতে কাম করে। হে অনেক ট্যাহা ঋণ করছে। বাড়িত থাকলে এই টাকা শোধ করতে পারতোনা। এই জায়গায় সব সময় তো কাম পায়না। এই কারণেই আমি তারে অন্য জায়গায় কামে পাডাইছি। যদি ঋণডা শোধাইতে পারে। আর পোলাপানও ছোড। বাজারে কেডা লইয়া যাইবো?
বারসিকনিউজ: তাহলে এখন আপনার সংসার চলে কিভাবে?
তাজমহল: হাঁস মুরগী, আর কয়ডা ডিম বেইচ্চা কিছু ট্যাহা জমাই। এই ট্যাহা দিয়া এক বস্তা চাউল কিনি। বাড়িতে ছোডো একটা পুশ্কুনি (পুকুর)আছে, মাছের চিন্তা করণ লাগেনা। জালি লইয়া নামলেই মাছ ধরন যায়। আর সব সব্জি তো আমার উডানেই আছে। এইডি দিয়াই পোলাপান লইয়া চলতে পারতাছি।
বারসিনিউজ: সব্জি বিক্রির টাকা দিয়ে কি করেন?
তাজমহল: পোলাপানের সংসার, কত্ত কিছু লাগে। হেরা ইস্কুলে যায়। খাতা, কলম, বই লাগে। টিফিনের ট্যাহা চায়। এইডি আমিই দেই। খালি পোলাপানের খরচ নাতো, অনেক সময় ঘরেও টুকটাক কত কিছু লাগে। বেডাইন মাইনষে কি সব আইন্যা দেয়? আমিই আনি। কিছু কিছু কইরা ট্যাহা জমায়া বাজারে যাইগা। কাপড়চোপড় কিনি, যা খাওনের মন চায় তাও কিনি।
আল্লার রহমতে বালাই আছি। রান্ধাবাড়ার সময় বাদ দিয়া সারাদিন ফসকৃষির কাম কইরাই সময় কাডাই। না খাটলে (পরিশ্রম) কেউ দিতো না। এইল্যাগ্যা (এর জন্য) আমি সব কাম নিজেই করি, মন দিয়া করি। আমার অহন সংসার চালাইতে চিন্তা লাগেনা। ট্যাহার দরকার পড়লে অনেক সময় কারো কাছ থেইক্যা আগাম ট্যাহা লই। পরে কোনো সব্জি দিয়া দেই। মেহমান আসে, অসুখবিসুখ আছে। কোনডা ট্যাহা ছাড়া অয়?
অনেক সব্জি আগুইল্যা (আগাম) লাগাই। ফলন দেয় বেশি। আর আগুইল্যা সব্জি বেচলে দাম বালা পাওয়া যায়। তহন কিছু ট্যাহা জমে। পরে কোনো দরকারে কামে লাগানি যায়। এইভাবেই চলতাছি।
বারসিকনিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
তাজমহল: আপনাকেও ধন্যবাদ।