নারীদের শ্রমে ঘামে হাসছে শীতের ফসল
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে অর্পনা ঘাগ্রা:
রংশিংপুর গ্রামটি কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বড় হাওরের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এই গ্রামের তিনটি আটিতে (উঁচু জমিতে) প্রায় ৪০টি পরিবার বসবাস করে। এই গ্রামের নারীরা বর্ষাকালে অবসর সময় অতিবাহিত করলেও শীতকালে থাকে মহা ব্যস্ততায়। প্রায় প্রতিটি নারীই বাড়ীর দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি শাকসবজি উৎপাদনের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকে। এই সময় পুরুষেরা বোরো ফসল ও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকে। তাই মূলত শাকসবজি উৎপাদন কাজের পুরো প্রক্রিয়ায় নারীরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। মাটি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যন্ত।
গ্রামটি হাওর অধ্যূষিত হওয়ায় এই অঞ্চলের নারীরা কেবলমাত্র নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মাত্র ৬ মাস শাকসবজি উৎপাদনের সুযোগ পায়। তাই তারা এই সময় জমির প্রতিটি অংশের যথোপযুক্ত ব্যবহার করে থাকে। এই গ্রামের নারীরা ফসল ফলায় মূলত নিজেদের পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশায়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। তাই তারা সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন করেন। প্রত্যেকটি নারীই বীজ সংরক্ষণ করে। হঠাৎ কোন বছর গোল আলু ও পেয়াজ জাতীয় বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে তারা বীজ কেনে। তাদের মধ্যে বীজ বিনিময়ের চর্চাও বিদ্যমান। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, প্রায় ২ শতাংশ পরিমাণ জমিতেও প্রায় ৮-১০ জাতের শাকসবজি তারা খুব সহজেই চাষ করতে পারে। তাদের উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে ২২ ধরনের (মটরশুটি, মাসকালাই, ক্ষেত শিম, শিম, মুগ ডাল, ডাটা, লাই, মরিচ, করলা, লাউ, মুলা, মিষ্টি কুমড়া, ২ জাতের বেগুন, টমেটো, ২ জাতের গোল আলু, পেয়াজ, রসুন, ধনিয়া, গোওয়ামুড়ি) শাক সবজি। তার মধ্যে প্রত্যেকটি পরিবারই ক্ষেত শিম নামক শিমটি অল্প পরিমাণে হলেও চাষ করে। কারণ এর বীজ তারা বর্ষাকালে খাওয়ার জন্য মজুদ রাখে। তাছাড়া এটি সংরক্ষণ করাও সহজ।
প্রতিবছরের মতোন এই বছরও প্রায় ৪ কাঠা (৩২ শতাংশ) পরিমাণ জমিতে প্রায় ২৪ জাতের শাক সবজি চাষ করেছেন জয়ন্তী রানী সরকার (৪৫)। তিনি বলেন, “আমি কোদাল দিয়া নিজেই মাটি কুবায় (খনন করা)। জমিতে গোবর, জৈব সার, ছাই দিই। বাজারের কোন সার, বিষ কিনিনা। আমি মাটি গর্ত কইরা ময়লা আবর্জনা ফালাইয়া জৈব সার বানাই। নিজেই বীজ বুনি। আগাছা বাঁছি। ডোঁবা থেকে কলসিতে পানি আইন্না ক্ষেতে দিই। এই শীত মৌসুমে আমরা বাজার থেকে কোন শাকসবজি কিনিনা।”
শাকসবজি চাষের ক্ষেত্রে বাদ যায়না প্রবীণেরাও। প্রবীণ প্রেমলতা সরকার (৬৮) তার প্রায় ১০ শতাংশ পরিমাণ জমিতে ১৫ জাতের সবজি চাষ করেছেন। এই বয়সেও সারাদিন সবজি ক্ষেত পরিচর্যা করার কাজে ব্যস্ত থাকেন তিনি। তিনি বলেন, “আমরা বছরে একবার মাত্র ফসল ফলাইবার সুযোগ পাই। তাই এই সময় আমরা বেশী পরিমাণে শাকসবজি মাড়াই (ফলানো)। জমি কম। এই কম জমিতেই সব মাড়াইতে (উৎপাদন) হয়। সব সময়তো এক জাতের শাকসবজি খাওয়া যায়না। তাই সব জাতেরই একসাথেই মাড়াই। নিজের ক্ষেতের সবজি এহন থেইক্যা খাওয়া শুরু করছি। বর্ষাকালের লাইগ্যাও মটর (মটরশুটি), ক্ষেত শিম, পেয়াজ, রসুন, আলু গুলা রাইখ্যা দিমু।” কৃষাণি রীনা রানী সরকার (৩৪) বলেন, “আমরা সবাই নিজেরাই বীজ রাখি। কারো কম পড়লে তাদের দিই। নিজে বীজ না রাখলে সঠিক সময়ে বীজ বুনতে পারতামনা। কারণ আমরা সঠিক সময়ে যদি বীজ বুনতে না পারি তাইলে যেকোন সময় পাহাড়ী ঢল আইস্যা সবকিছু শেষ কইরা দিতে পারে।”
বর্ষাকালের জন্য খাদ্যশস্য মজুদ রাখার এখনই উপযুক্ত সময় তাদের। তাই উপযুক্ত সময়ে তাদেরকে বীজ বপন করতে হয়। আর উপযুক্ত সময়ে বীজ বপনের জন্য তারা নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময় করে। জমি প্রস্তুত, বীজ বপন ও ফসল সংগ্রহের সময়ও তারা একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকেন। এই বছর বারসিক’র সহযোগিতায় কিছু কিছু কৃষাণি তাদের বৈচিত্র্যময় শাকসবজির সাথে আরো যুক্ত করেছেন মেথি, ছানা বুট (ছোলা বুট), মাস কালাই। এটি তারা এই বছরই প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ করে দেখছেন। বিশেষ ভাবে মেথি ও ছানা বুটের গাছ দেখে তারা জানিয়েছেন আগে এগুলো তারা শুধু বাজার থেকে কিনেছেন। গাছগুলো দেখার সুযোগ হয়নি। এই বছর গাছগুলো দেখার সুযোগ হচ্ছে। পরবর্তী মৌসুমে এগুলো তাদের উৎপাদিত ফসলের তালিকায় স্থায়ীভাবে স্থান পাবে। আর বৃদ্ধি পাবে ফসলের বৈচিত্র্যতাও।