জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি (রাজশাহী ॥
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে কারণে বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত বরেন্দ্র অঞ্চলে নানামূখী সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে খরার কারণে পানিসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৩০ শতাংশ জমি কোনো না কোনোভাবে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এমনকি কোনো এলাকায় তারও বেশি জমি পরিত্যক্ত থেকে যাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রান্তিক কৃষক জমি হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, অন্যদিকে মানুষসৃষ্ট দুর্যোগগুলোও বরেন্দ্রের জনগণ এবং এ অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি ডেকে আনছে। অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। আবার কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাঁরা তাঁদের ক্ষতি অনুযায়ী পাচ্ছেন না ন্যায্য ক্ষতিপূরণ।

অনাবৃষ্টি, তীব্র তাপদহ, খরা এবং পানি সংকটের কারণে ভবিষ্যতে এই এলাকায় সামজিক সহিংসতাসহ প্রাণবৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবন-জীবিকা এবং খাদ্য নিরাপত্তার সংকট ভয়াবহ হবার সম্ভাবনা আছে বলে আমরা বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণ-যুবকরা আশংকা প্রকাশ করছি। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমরা বরেন্দ্র অঞ্চল তথা বাংলাদেশের জনগণরা মোটেও দায়ী নই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমাদের যে লস এবং ড্যামেজ হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ পাওয়া আমাদের ন্যায়সংগত অধিকার।
সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরাম’র উদ্যোগে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ এনডিসি’র মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। একই সাথে বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ এবং ক্ষয়ক্ষতিসহ তরুণ-যুবসহ নানা পেশাজীবীর বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত করা হয় বিভাগীয় কমিশনারকে। স্মারকলিপি প্রদান ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামে আহবায়ক রুবেল হোসেন মিন্টু, সদস্য সচিব শাইখ তাসনীম জামাল, বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারি ও গবেষক শহিদুল ইসলাম, আদিবাসী যুব নেত্রী সাবিত্রী হেম্রম, যুব ফোরামের সদস্য শামীউল আলীম শাওন, আতিকুর রহমান আতিক, সাম্রাট রায়হান, বারসিকের অমিত কুমার সরকারসহ বিভিন্ন যুব সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ।
স্মারকলিপিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের জলাবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি বলায় দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু জলবায়ু পরির্বতনে আঞ্চলিকভিত্তিতে ক্ষয়-ক্ষতিগুলো সঠিকভাবে নিরুপণ করা হয়না। আঞ্চলিক বিবেচনায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে ক্ষতিপুরণ দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ সমঝোতার নামে বছরের পর বছর দেন দরবার করে কাটিয়ে দিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত তারা কালক্ষেপণ করছেন কিন্তু তারা কোন আসু সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি। এর ফলে সারা বিশ্বের যুব সমাজ জলবায়ু সংকট নিরসণে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বের ধনী দেশগুলোর কাছে জোর দাবী করছেন। ধনী দেশের কিশোরী প্রতিনিধি গ্রেটা থানবার্গ সম্প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দায়িত্বহীনতার জন্য সারা বিশ্বব্যপী যুবদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা বড়রা আমাদের কাছে মিথ্যা গল্প বলছ, এখনই তোমাদের বিলাসী জীবন বাদ দিয়ে কার্বন নির্গমন বন্ধ কর। কারণ একটাই পৃথিবী এটা না বাঁচালে ৭০০ কোটি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এই পৃথিবী থেকে বিলিন হয়ে যাবে।’ আমরা বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণ-যুবরা এবং আমাদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীও তার বক্তব্যের সঙ্গে ঐক্যমত প্রকাশ করেছেন এবং আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে স্থানীয়ভাবে আন্দোলন করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০-২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ বরেন্দ্র অঞ্চলেও জলবায়ু কর্ম-সপ্তাহ উদযাপন করা হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী বিশ্ব জলবায়ু কর্মসপ্তাহ উদযাপনে সংবাদ সম্মেলন, পানি সংকট নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জবানবন্দী, জলবায়ু পরিবর্তন ও তীব্র তাপদাহ নিয়ে মুক্ত সংলাপ, জলবায়ু ধর্মঘট ও অধিক কার্বন নিঃসরণকারী দেশসমূহকে লালকার্ড প্রদর্শন, খরা নিয়ে যুব ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক মতবিনিময়, খরারোধে গ্রামীণ নারীদের পানিবন্ধন, জলবায়ু ন্যায্যতায় বাইসাইকেল র্যালীসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো: জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দায়ী ধনীদেশগুলোর নিকট থেকে জলবাযুর ক্ষতিপূরণ আদায় করা; তাদের বিলাসী জীবন যাপন পরিত্যাগ করে কম কার্বন নির্ভর জীবনযাপনে বাধ্য করা; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের যে ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে সেই ক্ষয়-ক্ষতি সকল ক্ষেত্রে সকল অঞ্চলে নিরূপণ করা; জলবাযুর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে স্থানীয় জনগনকে সচেতন করা; জলবায়ুর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ যুব সমাজ গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে একতা তৈরী করা; যুব সমাজের সচেতনতা বাড়ানো এবং তাদের ভয়েসকে শক্তিশালী করা; স্থানীয় সরকার, যুব সমাজ, প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর জনগোষ্ঠি, এনজিও, সিভিল সোসাইটি, সাংবাদিক এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে একটি কার্যকর সম্পর্ক তৈরী করা; সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়া; একটাই পৃথিবী, এটাকে রক্ষা করার জন্য সবাইকে নিয়ে এক সাথে কাজ করা; দেশের সকল অঞ্চলের সকল মানুষের জেন্ডার ন্যায্যতা নিশ্চিত করা।

স্মারকলিপিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় পাঁচ দখা দাবি তুলে ধরা হয়:
১। বরেন্দ্র অঞ্চল তথা বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট নিরসণে অধিক কার্বন নি:সরণকারী শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোকে কম কার্বন নির্ভর জীবনযাপনে বাধ্য করার জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে দাবি তুলতে হবে।
২। জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দায়ী অধিক কার্বন নি:সরণকারী শিল্পোন্নত ধনীদেশগুলোর নিকট থেকে জলবাযুর ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে দাবি তুলতে হবে।
৩। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে সেই ক্ষয়-ক্ষতি সঠিক ভাবে নিরূপণ করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৪। জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলধার সূমহ (নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-দীঘি প্রভৃতি) সংরক্ষণ করতে হবে। সেগুলোকে দখল ও দুষণমুক্ত এবং সংস্কার করতে হবে।
৫। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক জলধারগুলোর মধ্যে খাল-বিল, পুকুর-দীঘিসূমহের লিজ প্রথা বাতিল করে প্রাকৃতিক জলধারগুলোতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিঃশর্তে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে জলধারগুলোর পানি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাদের কৃষিকাজ সহ প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে দিতে হবে।