তবুও তুমি বেঁচে থাকো…

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
মাতৃগর্ভে একটি ভ্রƒণ যখন বেড়ে উঠে তখন তার লিঙ্গ নির্ধারিত হয়ে যায়। পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই শুরু হয় বিভেদ। ছেলে হয়ে জন্মালে আযান, উলুধ্বনি দিয়ে তাকে বরণ করে নেয়া হয়। আর মেয়ে জন্মালে তাকে বরণ করে নেয়া তো দূর, পরিবারের মানুষদের মাঝে দেখা দেয় হতাশা, দুশ্চিন্তা। কারণ আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন মেয়েকে অনেক ধরণের হেনস্তার শিকার হতে হয়।


পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন ধরণের বাঁধা অতিক্রম করে, যন্ত্রণা সহ্য করে মেয়ে সন্তানটিকে বেঁচে থাকতে হয়। প্রতি পদক্ষেপে তাকে সম্ভ্রম হারানোর ভয় তাড়া করে। তাছাড়া আত্মীয়, পড়শীদের কটুক্তি শুনে পথ চলতে হয়। একটি মেয়ে সন্তানের শৈশব কাটে অনাদরে, যৌবনে নিরাপত্তাহীনতায়। আর সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর থেকে সংগ্রাম করে তার বাকি জীবনটা অতিবাহিত করতে হয়।


পড়ালেখা জানা বা স্কুলের গ-ি না পেরোনো মেয়েটিকে যখন শ^শুর বাড়িতে পাঠানো হয়, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় জীবন যুদ্ধ। প্রত্যেকটি নারীকে জীবনের এই ধাপে এসে বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। তবে পারিবারিক অবস্থা ও অবস্থানের প্রেক্ষিতে সেই সংগ্রাম ভিন্ন হয়ে থাকে। না, ঢালাওভাবে সবার কথা বলছিনা। এখানে শুধুমাত্র স্বল্প শিক্ষিত, প্রান্তিক গ্রামীণ নারীদের কথাই বলছি। বেশ কয়েকটি ঘটনার উপর দৃষ্টি রাখলেই বোঝা যাবে আমাদের দেশের কিছু কিছু গ্রামীণ নারী এখনো কত অসহায়। কত কিছু সহ্য করে টিকে আছেন।

ঘটনা-১
আতকাপাড়া গ্রামের হেমেলা আক্তার (৪০বছর), দুই সন্তানের জননী। এক সময় তাঁর স্বামীর নিজস্ব ধান ভাঙানোর মেশিন ছিল। সেখান থেকে বেশ ভালোই উপার্জন হতো। যা দিয়ে ৪জনের সংসার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর স্বামী উপার্জন আরো বৃদ্ধি করার আশায় বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ উত্তোলন করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই ঋণের টাকার পরিমান বাড়তে থাকে। সেই টাকা পরিশোধ করার জন্য তিনি পাগলপ্রায়। একদিন টাকা সংগ্রহের উদ্যেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। আজ প্রায় ১০বছর হলো, তিনি আর ফিরে আসেননি। বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুজি করেও এখন পর্যন্ত তাঁর হদিশ মিলেনি।
হেমেলা আক্তার মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে সংসারের হাল ধরেন। স্বামীতো পালিয়ে গিয়ে রেহাই পেয়েছেন, বাড়িতে থেকে হেমেলা ঋণের টাকা থেকে মুক্তি পাননি। স্বামীকে বাড়িতে না পেয়ে ঋণদাতাগণ তাঁর উপর চড়াও হয়। এবং তাঁকে টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য করে। কোনো উপায় না পেয়ে শুধু ভিটেবাগির জায়গাটুকু বাদ দিয়ে জমি, ধানের গোলা সব তিনি বিক্রি করে দেন।
যে ধানের গোলা একসময় নিজেদের ছিল সেখানেই তিনি দৈনিক মজুরিতে কাজ শুরু করেন। সংসারের চাহিদা পূরণসহ ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খরচ তিনি মিটিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা, প্রতিবেশিদের তীর্যক মন্তব্য তো আছেই।

ঘটনা-২
তিয়শ্রি গ্রামের আল্পনা আক্তার (২৮বছর), এক ছেলে ও এক মেয়ে। বাবার পরিবারে অভাবের তাড়নায় গার্মেন্টস্ এ চাকরি করতে যায়। সেখানে গিয়েই একজনের সাথে পরিচয় ও বিয়ে। বিয়ের পর তার দুটি সন্তানের জন্মের পর থেকেই আল্পনা বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী দিন দিন পাল্টে যাচ্ছেন। কোনো কোনো দিন রাতে বাড়ি আসেনা। সংসারের খরচ দেয়না। কিছু বলতে গেলে চলে শারীরিক অত্যাচার। একদিন আল্পনা জানতে পারেন তাঁর স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। সেই সংসারের খরচ চালায় এবং সেখানেই থাকবে বলে সে জানিয়েছে। আল্পনার সাথে আর সংসার করবেনা।
এই অবস্থায় আল্পনা দিশেহারা। ছেলেমেয়ের খরচসহ সংসার কিভাবে চালাবেন। কারণ বিয়ের পর সে গার্মেন্টস্ এর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। শেষে কোনো উপায় না পেয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখানেও সমস্যা। বাবার মৃত্যু হয়েছে, ভাইয়েরও সংসার আছে। তাকে সন্তানসহ ভরণপোষণ করবে কিভাবে। তাই বাধ্য হয়ে এখন তিনি কাঁথা সেলাই, অন্যের বাড়িতে ধান তোলার কাজ করে নিজের সংসার চালায়।

ঘটনা-৩
লিলতি রবিদাস, লক্ষীগঞ্জ (৪৫বছর)। স্বামী মারা গেছেন আট বছর হলো। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। কয়েক বছর আগে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এক ছেলে ঢাকায় সেলুন এ কাজ করে। আরেক ছেলেকে পড়াতে চেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলে শিক্ষিত হলে রোজগার করতে পারলে তাঁর কষ্ট কিছুটা কমবে। তাই তো এসএসসি পাশ করার পর ছেলেকে কলেজে ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু কলেজে যাওয়া তার হয়না। সারাদিন বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি আর মোবাইল দেখা। বড় ছেলে কাজ করা স্বত্ত্বেও সংসারের কোনো খরচ বহন করেনা। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পরও বছরের বেশিরভাগ সময় বাবার বাড়িতেই থাকে। সংসার চালানোর তাড়নায় লিলতি রাস্তায় মাটি কাটার কাজ যোগাড় করেছেন। সেটাও সারাবছর থাকেনা। যখন এই কাজ না থাকে তখন তিনি ধান ভাঙার গোলায় কাজ করেন। কখনো আবার লতা কুড়িয়ে বিক্রি করে সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

ঘটনা-৪
দরুন হাসামপুর গ্রামের তাজমহল আক্তার (৩৫বছর)। বিয়ের পর সংসার বেশ ভালোই চলছিল। কয়েক বছর পর তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর স্বামী নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। সারাদিন কোনো কাজ না করে সঙ্গীদের সাথে সময় কাটায়। সংসারে অভাব দেখা দেয়। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাজমহল খুব হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি আরো জানতে পারেন শুধু নেশাই নয়, পাশাপাশি তাঁর স্বামী ধার দেনা করেছেন প্রচুর। এগুলো শোধ করতে গিয়ে ধানের জমি, গরু সকল কিছু বিক্রি করতে হচ্ছে। আস্তে আস্তে সব বিক্রি শেষ, শুধু বসতবাড়ির জায়গাটুকু তাজমহল রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
আগে থেকেই তিনি সব্জী চাষ করতেন, তবে সেটা ছিল খুব অল্প পরিমাণে। এরপর সংসার চালানোর জন্য ঘরের জায়গাটুকু বাদ দিয়ে বাড়ির সমস্ত জায়গায় সব্জী চাষ করতে শুরু করেন। স্বামী এখনো নেশা ছাড়তে পারেননি। নেশা করার কারণে নিজের এলাকাতে তাকে কেউ কাজ করাতে চায়না। বাধ্য হয়ে সে অনত্র্য চলে যায়। সেখানে গিয়েও অভ্যাসের পরিবর্তন হয়নি। বাড়িতে কোনো টাকা পাঠায়না। তাজমহল তাঁর সন্তানদের নিয়ে সব্জী চাষ ও বিক্রি করে টিকে আছেন।

ঘটনা-৫
রোজিনা আক্তার (৩২বছর), নসিবপুর গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী দেখতে সুন্দর, বাড়িতে সম্পদ আছে। যা দেখে বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে যেনো সুখে থাকে। কিন্তু সেটা হলো না রোজিনার। স্বামী সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, কোনো কাজ করেনা। জমি বিক্রি করে, আর সেই টাকা দিয়ে নিজের চাহিদা পূরণ করে। রোজিনার শ^াশুড়িও সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি বেড়ায়। সংসারের সব কাজ তাকেই করতে হয়। কোনো কাজে ত্রুটি ধরা পড়লে চলে শারীরিক অত্যাচার। অকথ্য গালাগালি তো আছেই।


স্বামী একসময় বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় এবং রোজিনাকে বাধ্য করে বাবার কাছ থেকে সেই টাকা এনে দিতে। প্রায় ৬ বছর যাবৎ সে বিদেশে আছে। কিন্তু রোজিনার উপর অত্যাচার এখনো কমেনি। শারীরিকভাবে অত্যাচারিত না হলেও মানসিক অত্যাচার লেগেই থাকে। স্বামী বিদেশে থেকেও প্রতিনিয়ত, বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে যাচ্ছে। এছাড়া পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশিদের কথা লেগেই আছে।


স্বামী টাকা পাঠায় তার বাবার কাছে। সে টাকায় রোজিনার হাত দেয়ার সাহস নেই। কিছু চাইতে গেলে আবার শুরু হয় সংসারে অশান্তি। শ^শুর শ^াশুড়ি যা দেয়, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে। রোজিনার ৮ বছরের একটি মেয়ে আছে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে সব সহ্য করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে এমন হাজারো হেমেলা, রোজিনা, আল্পনা আছেন। যারা নিজের সংসারটা সাজানোর আগেই ভেঙে যায়। সেখানে অবস্থান গড়ে তোলা তো স্বপ্ন। তাঁদের পথ চলায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার ও সমাজের কিছু বর্বর ও নিচু মানসিকতার মানুষ। শত চেষ্টা করেও তাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনা। জীবনটাকে যাপিত করে শুধু, উপভোগ করতে পারেনা।
নারী, তবুও তুমি বেঁচে থাকো। সংগ্রাম করে বাঁচো। তুমি সৃষ্টি করতে জানো, রক্ষা করতে জানো। তোমার শিক্ষায় একজন সন্তান মানুষ হয়ে গড়ে উঠে। প্রকৃতি তার রূপ ফিরে পায়। টিকে থাকে সকল বৈচিত্র্য।

happy wheels 2

Comments