মানুষকেন্দ্রিক দুনিয়াকে করোনার বার্তা
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
সৌরজগতের এই ছোট্ট গ্রহে মানুষের বিবর্তন ও বিকাশ খুব বেশি দিনের না। প্রজাতি হিসেবে মানুষ খুব সবলও নয়। খালি চোখে দেখা যায় না একটা ভাইরাস যা পারে মানুষ কী পারে? একটা বুনোলতাও যা পারে, মানুষ তা পারে না। নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। কেবল খাদ্য নয়, অক্সিজেন বলি পানি বলি সবকিছুর জন্যই মানুষকে নির্ভর করতে হয় অন্যের ওপর। শতভাগ পরনির্ভরশীল এই প্রজাতিই দুম করে অন্যসব প্রাণপ্রজাতিকে হটিয়ে এই দুনিয়া একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলো। কি নিদারুণ! কী অকৃতজ্ঞ অনাচার!! লাখো বছর ধরে যে জীবাশ্ম জমা হয় মাটির অতলে মানুষ তাকে টেনেহেঁচড়ে ‘জ্বালানি’ নামে বাজারে তুললো। লুন্ঠিত হলো দেশদুনিয়ার প্রাণসম্পদ। খুব বেশি দিনও নয়, মোটাদাগে কয়েকশ বছর। মানুষ তার নিজের ভোগ আর বিলাসিতাকে তরতাজা রাখতে পৃথিবীর বৃহৎ পরিবার থেকে অন্য প্রজাতিদের খুন করলো, হটিয়ে দিল। নিজের একটা লম্বা দালান আর মেগামল বানাতে ব্যাঙ কি কাঁকড়াদের কাছ থেকে কেড়ে নিল শেষ ডোবাটি। পাখিদের তাড়িয়ে, বাঘেদের খেদিয়ে, ফড়িংদের মেরে, গাছেদের খুন করে মানুষ এক লম্বা সময় ধরে কেবল তার নিজের কথাই ভেবেছে। যেন দুনিয়ায় আর কোনো প্রাণপ্রজাতি নাই। বৃক্ষ কী প্রাণীর দয়ায় বেঁচে থাকা মানুষ ভুলেই গেল সে নিতান্তই এক পরনির্ভরশীল প্রজাতি। প্রাণপ্রকৃতি লুট আর খুন করে চলা এই লম্বা সময়ের নামই মানুষের অভিধানে ‘শিল্পবিপ্লব’ আর ‘উন্নয়ন’। চলতি আলাপখানি ‘উন্নয়ন’ বনাম ‘পরিবেশ’ গোছের কোনো অমীমাংসিত তর্ক নয়। আলাপখানি চলমান করোনাকালের এক প্রকাশ্য সহজ সরল বার্তাকে ঘিরে। যা গ্রাম থেকে শহর বিশ্বব্যাপি সব মানুষ দেখতে পাচ্ছেন। কী এই সরল বার্তা? কী নির্দেশনা সরাসরি জানান দিচ্ছে এই নির্দয় করোনাকাল? লকডাউন, সঙ্গনিরোধ কী শারীরিক দূরত্ব মানার এক বাধ্যগত পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনযাপনে তেমনি চারধারের প্রাণপ্রজাতিতেও তৈরি হয়েছে আরেক ভিন্ন সাড়া। ঘরবন্দি মানুষের দুনিয়ায় যেন একটুখানি হলেও মুক্ত পরিবেশ পেয়েছে পাখি, পতঙ্গ, বৃক্ষ কী বন্যপ্রাণ। করোনাকাল প্রমাণ করে চলেছে মানুষ একতরফাভাবে দুনিয়ার সকল প্রাণপ্রজাতির জন্য এক দমবন্ধ শৃংখলিত মুর্মূষু পৃথিবী চলমান রেখেছিল এতদিন। আর এটিই করোনাকালের সহজ সরল বার্তা। গ্রামের ছোট্ট শিশু থেকে শহরের প্রবীণ, সমতল থেকে পাহাড় কী নিউইয়র্ক থেকে নোয়াখালী সবাই চারধারের প্রকৃতি ও প্রাণপ্রজাতির এই পরিবর্তন বুঝতে পারছে। প্রশ্ন হলো এই বার্তা আমাদের অন্তর ও মগজে দাগ কাটছে কীনা? আমরা এই নির্দেশনা কি করোনা সংকটের পর ভুলে যাবো? নাকি এই বার্তাকেই প্রজাতি হিসেবে মানুষ এই গ্রহে তার বেঁচে থাকার মূল জীবনদর্শন হিসেবে গ্রহণ করবে। কাজটা কী খুব কঠিন? কোনোভাবেই না, এর চাইতে সহজ কাজ হয়তো দুনিয়ার আর একটিও নেই। কেবল চিন্তাটা বদলাতে হবে, দুনিয়াটা কেবল মানুষের নয়, এখানে প্রজাতি হিসেবে কারো বাহাদুরি করবার কিছুই নাই। এই এথনোসেন্ট্রিক বা মানুষকেন্দ্রিক ভাবনাটাকে সরিয়ে দুনিয়াটা সবার এই সহজ অনুশীলনটিই আমাদের সকল বিপদ মোকাবেলার রসদ জোগাবে সামনে।
এক আদি পরিবেশ-দর্শন
চীনে করোনা সংকট শুরু হলে জানুয়ারিতে ‘করোনা ও পরিবেশপ্রশ্ন’ নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আজ তিন মাস পর বিশ্বব্যাপি পরিবেশপ্রশ্নকেই করোনাসংকট বিশ্লেষণে টেনে আনছেন অনেকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ে নানা আলাপ শুরু হয়েছে। পরিবেশ-প্রশ্নের এই আলাপের ময়দান বিস্তৃত করা জরুরি। পরিবেশ ডিসকোর্সে অনেক চিন্তাদর্শন আলোচিত হয়। মানবতাবাদ, মানুষকেন্দ্রিক মতবাদ, তত্ত্বাবধায়ন মতবাদ, প্রাণকেন্দ্রিক মতবাদ, প্রাণীর অধিকার, প্রতিবেশকেন্দ্রিক মতবাদ কী প্রতিবেশ-নারীবাদ। চলতি আলাপে আমার এক আদি মান্দি সাংসারেক পরিবেশ-দর্শনের কথা মনে আসছে। এই আদি দর্শনমতে, দেবতা বাগবা-বরম্বির চিপাংফাকসা (তলপেট) থেকে দুনিয়ার সকল প্রাণ-প্রজাতির জন্ম হয়। এ কারণে সকল প্রাণ-প্রজাতি একই সংসারের বাসিন্দা। এর নামই জগতসংসার। এই সংসারে একটা বনরুই বা অজগর বিপদে পড়লে এর প্রভাব মানুষ কী পাখিদের সংসারেও পড়ে। একটা উঁইঢিবির শরীর দেখেই বোঝা যায় গ্রামের মানুষ কোনো অসুখে পড়বে কীনা? সাংসারেক মতে, দুনিয়ায় সকলেই ভূমি থেকে আসে আবার ভূমিতে ফিরে যায়। এই নিরন্তর যাত্রায় মানুষ নানা প্রাণপ্রজাতিতে জীবন পায়, কখনোবা মানুষ হয়ে। আর তাই মানুষ মাটি, পানি, বৃক্ষ কী কোনো প্রাণপ্রজাতির ওপর একতরফা খবরদারি করতে পারে না। কোনো কিছু গ্রহণ করার আগে প্রকৃতির কাছে নতজানু হতে হয়, অনুমতি নিতে হয়। এই দুনিয়ায় কেউ কাউকে এককভাবে সুরক্ষা দিতে পারে না, সবাই মিলেই সবার নিরাপত্তা সামাল দেয়। একতরফাভাবে পৃথিবী কেবল মানুষের নয়, মানুষও এই পৃথিবীর। করোনাকালে মান্দি সাংসারেক দর্শনের মতো দেশ দুনিয়ায় এমনতর সহ¯্র নি¤œবর্গীয় বয়ান বারবার উছলে পড়ছে চারধারে। কিন্তু মান্দিরাও এই দর্শন আজ চর্চায় জিইয়ে রাখতে পারেনি। নয়াউদারবাদী দুনিয়ায় সব কিছুইতো তছনছ হয়েছে। মহামারী সামালে ‘দেনমারাংআর’ মতো মান্দিদের নিজস্ব লকডাউন প্রথা জারি রাখার বিদ্যা কে আর জানে এখন! কিন্তু করোনাকালে এই আদি সাংসারেক দর্শনের মতো করে কী আবার ভাবা যায়? দুনিয়াটা সবার। পৃথিবীটা মানুষের নয়, মানুষই এই পৃথিবীর। চিন্তার এই একটা বদলই দেখা যায় আবার বদলে যেতে পারে আমাদের চারধার। বৃক্ষলতাগুল্ম, মাছ, পাখি, পতঙ্গ, শামুক, মানুষ, ঘড়িয়াল, শুশুক, বাঘ কী সরীসৃপ সবাইকে নিয়েই এক বৃহৎ জগতসংসার।
বারান্দার টুনটুনি আর চনমনে কুমড়ো ডগা
ঢাকায় আমাদের ছোট্ট বারান্দায় চড়াই, টুনটুনি, শালিকের অস্থির ডাকাডাকি। মরিচ আর কুমড়ো ডগাগুলিও চনমনে। পাতার শরীরে কোনো ধূলি-ময়লা নেই। পিঁপড়া আর মাকড়সাগুলোকেও যেন আরো চটপটে। টবের মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে খুদে কেঁচোছানা। ঘরবন্দি সময়ে এখন এসব পর্যবেক্ষণে সময় বেশি পাওয়া যাচ্ছে বলে নয়, এই অবস্থা বিগত দীর্ঘদিন চোখে পড়েনি। আর এই ছোট্ট বারান্দা কেবল নয়; শহর কী গ্রাম নয়, দুনিয়াজুড়ে প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের দারুণ সব ঘটনা প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। ঢাকা শহরে এতো পাখিদের কলবর হয়তো আগে হর্ণের মাস্তানিতে ঢাকা পড়তো কিন্তু পাখিদের আচরণ নিশ্চয়ই খেয়াল করছি আমরা। শহরে পাখিদের আচরণে সেই বুনোস্বভাব যেন ফিরে আসছে, দ্বিধাহীনভাবে ওড়ছে ঘুরছে তারা। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে কচ্ছপ, ডলফিন কী সমুদ্রলতার বিস্তার অনেকদিন দেখা যায়নি। সুন্দরবনে এখন চলছে মধুমওসুম। জানবাজি রেখে মধুসংগ্রহে যাওয়া মৌয়ালেরা জানিয়েছেন, বনের এমন ‘বুনো রূপ’ ঢেরদিন তারা দেখেননি। সাতক্ষীরার শ্যামনগরে হরিণ চলে আসছে মানুষের বসতিতে। লাউয়াছড়া, রেমা-কালেঙ্গা, সাতছড়ি, রাতারগুল, পাবলাখালি, ডুলাহাজরা, মধুপুর শালবন কী পাহাড়ি জংগলেও সবুজের নানা রঙের ছোপ অনেকদিন পর। বলা হচ্ছে মানুষের চলাচল বন্ধ বলেই দূষণ কমেছে। বন্যপ্রাণেরা বিচরণের জন্য কিছুটা হলে পরিসর পাচ্ছে। তার মানে করোনাকাল প্রমাণ করেছে এককভাবে মানুষই সকল বন্যপ্রাণের জায়গা দখল করে রেখেছিল। কেবল নিজের জন্য নয়, সকলের জীবনের জন্যই দূষিত আর বিপদজনক করে রেখেছিল পৃথিবীকে।
লোভের সঙ্গ ও সঙ্গনিরোধের দুর্নীতি
করোনা বিস্তারের এক অন্যতম কারণ দুর্বল সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা। বিদেশফেরতদের যেমন কঠোরভাবে সঙ্গনিরোধ করিনি আমরা ঠিক তেমনি কী অন্য দেশ থেকে সঙ্গনিরোধহীনভাবেই দেশে প্রবেশ করে উদ্ভিদ বা প্রাণী। অথচ সঙ্গনিরোধের কঠোর আইন ও বিধি আছে। আর তাই দেখা যায় বহুজাতিক বীজ কোম্পানির বীজের প্যাকেটে চলে আসে নানা বালাই। অচেনা পঙ্গপালে ভরে যায় জমিন। ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া, শিশু, আফ্রিকার মাগুর, তেলাপিয়া কী সিলভারকার্পের মতো আগ্রাসি ও অ্যালিয়েন প্রজাতি গুলোকে রাষ্ট্রই অনুমোদন করেছিল। দীর্ঘসময় বাদে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ আগ্রাসি প্রজাতি নিষিদ্ধ করে। যেমন কয়েকবছর যাবত আফ্রিকার এক জায়ান্ট মিলিবাগ/ম্যাংগো মিলিবাগে ভরে যাচ্ছে ঢাকার গাছপালা। ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। করোনার বিস্তার যেমন আমরা বন্দরে আটকাতে পারিনি, এই জায়ান্ট মিলিবাগেরাও দেশে ঢুকেছে দুর্বল সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থার কারণেই। প্রতিটি প্রতিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের একটা নিজস্ব ব্যাকরণ ও বিবরণ আছে। দুম করে জোর করে কোনো কিছু আমদানি করলে সেই বাস্তুসংস্থানের খাদ্যশৃংখল ওলটপালট হয়ে যায়। তৈরি হয় বিশৃংখলা। যার নিদারুণ প্রভাব পড়ে খাদ্য ও স্বাস্থ্যের ওপর।
করোনাকালের সরল উপলব্ধি
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮.ক অনুচ্ছেদ বলেছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করবে। ‘বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন ২০১৭’ অনুযায়ী ‘প্রাণবৈচিত্র্য’ বলতে জীবজগতের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্নতা বোঝানো হয়েছে। যা পরিবেশের অংশ এবং স্থলজ, জলজ বা সামুদ্রিক পরিবেশে বিদ্যমান প্রজাতিগত, কৌলিগত ও প্রতিবেশগত বিভিন্নতাকে বোঝায়। নিদারুণভাবে প্রাণবৈচিত্র্যের সংজ্ঞায় ‘মানুষ’ নেই। মানুষ কী তাহলে এই অসীম জীবজগতে বিরাজমান বিভিন্নতার বাইরের কেউ? আমাদের এই এথনোসেন্ট্রিক বা মানুষকেন্দ্রিক চিন্তাকে বদলাতে হবে। মানুষও প্রাণজগতের অন্য কোটি প্রাণের মতোই এক জীবন্ত সত্তা। করোনাকাল আবারো মানুষকে এই উপলব্ধি জানান দিচ্ছে। নিয়ন্ত্রক নয়, মানুষ নিজেকে এই প্রাণজগতের অংশ মনে করতে শিখুক। আর এই উপলব্ধিই বদলে দিতে পারে দুনিয়ার সকল ক্রান্তিকাল।