সাম্প্রতিক পোস্ট

বাইডেন সম্মেলন এবং পিপাসার্ত উপকূল

পাভেল পার্থ:

মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধানের উদ্যোগে শুরু হওয়া ‘ওয়ার্ল্ড লিডার্স সামিট’ পরিচিতি পেয়েছে ‘বাইডেন জলবায়ু সম্মেলন’ হিসেবে। বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে ভার্চুয়ালি আয়োজিত এই সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চারটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার তুলে ধরছেন। করোনা মহামারিকালে প্রাণ-প্রকৃতির গুরুত্বকে আমলে নিয়ে জলবায়ু সুরক্ষায় বিশ্বনেতাদের এমন আয়োজন পৃথিবী পুনরুদ্ধারের আশা জাগায়। এই ধরনের বৈশ্বিক আয়োজনকে যদি বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্র ধরি তাহলে দেখতে পাব, এর চারধারে তড়পাচ্ছে এক জলবায়ু-বিপর্যস্ত চুরমার দুনিয়া। খরা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহ, গরম বাতাস, পাহাড়ি ঢল বাড়ছেই। হাহাকার, অসহিষ্ণুতা আর নিরাশার কলিজা নিয়ে বাড়ছে এক নতুন প্রজন্ম। দুঃসহ এই করোনাকালে ফাল্কগ্দুন থেকে দেশের উপকূল অঞ্চলে পানির সংকট শুরু হয়েছে। রুক্ষ বসন্ত মাড়িয়ে বৈশাখের এই তীব্র তাপদাহে পুড়ছে মাটি, নোনা ধুলা উড়ছে গায়। কিন্তু কোথাও এক ফোঁটা পানি নেই।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের নানা গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। অনেকেই গোসল করেননি সপ্তাহ পার হয়েছে। শাকসবজি ধুতে বেশি পানি লাগে বলে অনেকেই এসব রান্না করছেন না। রান্নাবান্নায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন নারীরা। পেটের পীড়া, চর্মরোগ, ব্যথাসহ অসুখে পড়ছে শিশু থেকে প্রবীণ। ঘরে জমানো পানি শেষ, ডোবা-পুকুর-খালেও পানি শুকিয়ে গেছে। কিনে খাওয়ার পানির জন্য দিতে হচ্ছে লম্বা লাইন। নারী ও শিশুর জন্য পানি সংগ্রহ ও মজুতে বাড়ছে নানামুখী কাজের চাপ। পানির জন্য বদলে যাচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক, তৈরি হচ্ছে নয়া দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

এমন নয় যে, পানির এই হাহাকার নতুন। কিন্তু করোনা মহামারিকালে পানির এই যন্ত্রণা নতুন রূপ নিয়েছে। কারণ করোনা স্বাস্থ্যবিধি পালনে বারবার হাত ধোয়া থেকে শুরু করে পানির ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি পানির উৎস এবং মজুদ। বরং কমছে দিন দিন। এ ছাড়া ইটভাটাসহ শহর থেকে আসা দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষেরা এখন চাইলেই আগের মতো প্রতিবেশীর পুকুর ও পানির স্থান ব্যবহার করতে পারছেন না। এতে তৈরি হচ্ছে আরও সামাজিক জটিলতা। পুরো শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, আশাশুনি যেন বিষণ্ণ নোনা এক হতাশা হয়ে আছে।

বৈশাখেও নেই কালবৈশাখী, ঝড় কি বৃষ্টি। এই দুর্মর পানিহীনতায় কে বাঁচতে পারে? মানুষ, ধান জমিন বা গবাদি প্রাণিকূল? পানির এই অদলবদলের সঙ্গে টিকে থাকতে উপকূলের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই নানা লোকায়ত চর্চা গ্রহণ করেছে। অভিযোজিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজের শরীর, চাহিদা, উপকরণ, কৌশল কি সংস্কৃতি। উপকূলের এই পানিযন্ত্রণা সারাতে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যায়তন, এনজিও, নানা ব্যক্তি কি ব্যবসায়িক পর্যায়েও নেওয়া হয়েছে নানা প্রকল্প। কিন্তু পানির যন্ত্রণা কমেনি। এই বৈশ্বিক মহামারিকালে পানিশূন্য হয়ে আছে দেশের এক বিশাল অঞ্চল। তীব্র খরা ও তাপদাহে মাটি থেকে শুরু করে বাতাসও যেন তীব্র নোনা হয়ে উঠছে। বিশ্বনেতৃত্বকে এই পানির যন্ত্রণা বুঝতে হবে। কেবল উপকূল নয়, দেশের নানা প্রান্ত আজ নানামুখী জলবায়ু বিপর্যয়ে কাহিল। বাংলাদেশসহ দুনিয়াজুড়ে জারি থাকা এমন রক্তক্ষরণকে বুকে আগলে দাঁড়াবার সাহস করতে হবে বিশ্বনেতৃত্বের।

কেন এমন পানিশূন্য হলো পানিময় উপকূল? সাগরের ঢালাও ছলছল, নদীর হাড়গোড় আর জমিন থেকে জমিন। চারদিকে চারপাশে পানি আর পানি। কিন্তু কোথাও এক দানা পানি নেই। একটি পরিবারে দিনে লাগে ছয় কলস পানি, আনতে হয় কয়েক মাইল হেঁটে। বর্ষায় হাঁটুসমান দগদগে কাদা আর শীতে হিম কুয়াশার ছোবল সহ্য করে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে পানির গতিকে উন্নয়নের ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে কাটা হয়েছে। পানি আর পানি নেই। চারদিকে মরা পানির দুঃসহ নোনা লাশ। প্রথমত চিংড়ি ঘের গলাটিপে হত্যা করেছে উপকূলীয় কৃষির ভিত্তিভূমি। নোনার অত্যাচারে ঝলসে গেছে মাটি কি মাছ, পাখি কি পতঙ্গ। প্রশ্নহীন এক উপকূলীয় বাঁধ তৈরি করে নদীগুলোকে আলাদা করা হয়। গ্রামীণ পুকুর আর জলাধারগুলোও হয়ে ওঠে মৎস্য খামার। খালের সঙ্গে নদীর প্রবাহ আটকে শুরু হয় লবণপানির স্থায়ী জলাবদ্ধতা। বাড়তে থাকে কৃষি থেকে উদ্বাস্তু মানুষের দিনমজুরির জীবন। এককালে ঘি-দই-মিষ্টির জন্য যে অঞ্চলের চারধারে ছিল টইটম্বুর খ্যাতি। আজ সে অঞ্চলে কোনো গরু-ছাগল নেই। গরু চরানোর একটি মাঠ নেই, নেই একবিন্দু ঘাস। বছর বছর লবণাক্ততা বাড়ছে এই উপকূলে। বাংলাদেশের মোট লবণাক্ত এলাকার ৫৭ ভাগই এই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে বিস্তৃত। পরিবেশগত বিপর্যয় এবং নানাবিধ উন্নয়ন যন্ত্রণার দাগের সঙ্গে উপকূল ধুঁকছে জলবায়ু বিপর্যয়ের তীব্র ক্ষত নিয়ে। বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়, অনাবৃষ্টি, মৌসুমি খরা, লবণাক্ততার তীব্রতা ও মাত্রা। সিডর, আইলা, মহাসেন, ফণী, বুলবুল, আম্পান একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড হচ্ছে জীবন। কত আর ঘুরে দাঁড়াবার সাধ্য থাকে মানুষের? তাও যদি পিপাসাকাতর কলিজায় একটুখানি পানি পাওয়া যায়।

পানি ও জীবনের ঐতিহাসিক গভীরতম সম্পর্ককে বিবেচনা না করে নানা সময়ে উন্নয়ন কর্মসূচির নামে গাড়ি করে ড্রামে ড্রামে মিষ্টি পানি এনে বিক্রি করেছে অনেকে। এক পরিবার মাত্র এক কলস পানির আশায় কুয়াশা কি বৃষ্টির ছোবল নিয়ে ভোররাতেই দিচ্ছে আসমান-পাতাল লম্বা লম্বা লাইন। এনজিওদের ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির যেমন একটি হিসাব বই থাকে, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ‘উপকারভোগী/লক্ষিত জনগোষ্ঠীর’ জন্য তেমনই একটি পানি-হিসাবের বইও তুলে দিয়েছে। পানি আর পানি থাকছে না, থাকছে না জীবনের অধিকার। তৈরি হচ্ছে গ্রামীণ সমাজে গরিবের সঙ্গে গরিবের সংঘর্ষ ও বিবাদ। গরিব বনজীবী এবং কৃষি উদ্বাস্তু মানুষের ভেতর সামাজিক সম্পর্ক উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। দিনে দিনে বননির্ভর মৌয়াল, বাওয়ালি, চুনারি, সুতার, মাঝি, মুণ্ডা, জেলেদের জীবিকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং বনসংলগ্ন বনজীবী পরিবারের নারীরা চিংড়ি পোনা আহরণ করতে বাধ্য হয়েছেন। নোনার জ্বালা সামাল দিতে অপেশাজীবীরা ঢুকছে বাদাবনে। নোনার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটিও।

দিনে দিনে অসহ্য রকমের উষ্ণ হয়ে উঠছে চিংড়ি ঘের এলাকা। গরমের দিনে শরীর ঘাম দিয়ে নুনের সাদা সাদা ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু পানি সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে এখনও সবাই একত্র হয়নি। একত্র করেনি সবার ভাবনা, শ্রম আর বাজেট। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানি সমস্যার নিরসন কোনোভাবেই স্থানীয় পর্যায়ের কোনো বিষয় নয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের নানা সূত্র। প্রথমত, এই সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু সম্মেলনের মতো বৈশ্বিক মঞ্চে এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর দেনদরবার সক্রিয় করতে হবে। কেবল অভিযোজনের ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা নয়; জলবায়ু-কূটনীতিতেও দেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

গবেষক
[email protected]

happy wheels 2

Comments