পরিবেশবান্ধব চুলা বস্তিবাসীর স্বাস্থ্য সুক্ষায় ভূমিকা রাখবে

রাজশাহী থেকে অমিত সরকার

জলবায়ু সংকটে প্রতিবছর নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ভিটেমাটিহারা হয়ে নতুনভাবে বাঁচতে বহু পরিবার পাড়ি জমায় রাজশাহী শহরে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে বেঁচে থেকে জীবন ধারণ করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত এসব মানুষের আবাসস্থল হয় রাজশাহী শহরের বিভিন্ন বস্তিতে। বস্তিগুলোতে সাধারণত বসবাস করে সমাজের নিম্ন আয়ের ছোট দোকানি, গৃহকর্মী, রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, শ্রমজীবীরা। দেশে বসবাসরত জনসংখ্যার বিভিন্ন সমস্যা জনপ্রতিনিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনো না কোনো সময় সমাধান হয়। কিন্তু আমাদের দেশের বসবাস করা বস্তিবাসীর জীবনপট বহু বছর ধরে একই। নেই কোনো পরিবর্তন। দুর্দশায় কাটে তাদের জীবন। কোনো প্রকার নাগরিক সুবিধা, আধুনিকতার ছোঁয়া দেখা যায় না বস্তিবাসীদের জীবনে। অস্তিত্বের সংকটে কাটে তাদের জীবন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে উচ্ছেদ অভিযান বস্তিবাসীদের জীবনে তৈরি করে নতুন দুর্ভোগ।

দেশের বস্তিগুলোতে রয়েছে মৌলিক চাহিদা পূরণের অপ্রতুলতা। একই ঘরে গাদাগাদি করে অনেক লোকের বাস, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নিরাপদ পানীয় ও খাদ্যের অভাব, শিক্ষা-চিকিৎসার বালাইহীনতা, নানা রকম রোগব্যাধি নিত্যসঙ্গীসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত আমাদের দেশের বস্তিগুলো। ক্ষুদার জ্বালায় আর্তনাদ, চিকিৎসার অভাবে সজ্জাশায়ী, শিক্ষার অভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সচেতনতার অভাবে নানা ধরনের অপরাধকাজে লিপ্ততা—এ বিষয়গুলোই দেশের প্রতিটি বস্তির বাস্তব চিত্র।

বস্তিবাসীদের নানান সমস্যার মধ্যে রান্নার সমস্যা একটি বড় সংকট সৃষ্টি করেছে। রাজশাহী নগরীর ভদ্রা এলাকার রেললাইন এর ধার ঘেসে গড়ে উঠা জামালপুর বস্তিতেও একই চিত্র। দেশের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম থেকে আগত মানুষ গুলো ছোট ছোট জায়গায় টিনের ঘর তুলে কোনরকমে ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। বস্তিতে বসবাসকারী নগর প্রান্তিক মানুষের জায়গা স্বল্পতার কারণে ছোট ছোট ঘরের মধ্যে রান্না খাওয়া থাকা সব কিছুরই আয়োজন হয়ে থাকে। ফলে নানান সমস্যার মধ্যে রান্না করতে করতে গিয়ে তাদের সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের সংকট।

জামালপুর বস্তিতে বসবাস কারী চম্পা বেগম(৪২) জানান, আমাদের অল্প জায়গার মধ্যেই থাকার ঘর আবার সেই ঘরের আঙ্গিনায় রান্নাকরার জায়গা। আমরা বিভিন্ন গাছের পাতা খড়ি দিয়ে রান্না করি তাই রান্না করার সময় অনেক ধোঁয়া হয়। ধোঁয়ার কারণে আমাদের চোখের সমস্যা হয়,শ্বাসকষ্ট হয় মাথা ঘুরায় তবুও রান্না করতে তো হবেই না হলে খাবো কি করে। একই বস্তির রাহেলা বেগম (৪৬) জানান, রান্নার ধোঁয়ায় আমাদের অল্প বয়সেই চোখে ছানি পড়া সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমাদের ছেলে মেয়েদের রান্না করার সময় ঘরে থেকে বাইরে বের করে দেই ধোঁয়ায় থাকতে পারেনা ঘরে। ধোঁয়ায় আমাদের ঘরের টিন গুলো নষ্ট হয়ে যায় তারাতাড়ি। কালি পড়ে যায় টিনে।’

চম্পা বেগম ও রাহেলা বেগম এর মতন একই বস্তিতে বসবাসকারী সাবরিনা,হাসি,আইরিন, সাবিনা বেগমরা বলেন, ‘আমাদের রান্নার ধোঁয়ার কারণে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা হয়। আমরা চারপাশের গাছের পাতা খড়ি কুরিয়ে জাল করি তাই ধোঁয়া বেশি হয়। ঘর নষ্ট হয় তারাতাড়ি জামা কাপর ও নষ্ট হয়ে যায় ধোঁয়ার কালিতে। জামালপুর বস্তিতে বসবাস কারী প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের এমন সমস্যার কথা জানার পর বারসিক’র পক্ষ থেকে পরিবেশবান্ধব চুলার বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয় তাদের। পরিবেশবান্ধব চুলার বিষয়ে বিস্তারিত জানার পর ১৬টি পরিবার পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সাশ্রয়ী উন্নত চুলা ব্যবহারে উদ্যোগী হয়ে চুলা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। উন্নত চুলা ব্যবহারে কার্বনডইঅক্সাইড কম নির্গমন হয়। ফলে জলবায়ু পরবর্তনের ঝুঁকি হ্রাস পায়। একটি জ্বালানি সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ুবান্ধব এই চুলা ব্যবহারে আগ্রহী ভূমিহীন নগরপ্রান্তিক মানুষের জন্য বারসিক চুলা তৈরি প্রশিক্ষণ প্রদান ও উন্নত চুলা সম্প্রসারণে সহায়তা করার উদ্যাগ গ্রহণ করে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলায় উন্নত চুলা তৈরিতে অভিজ্ঞ কবুলজান বেগমের সহযোগিতায় রাজশাহীর জামালপুর বস্তিতে ১৬টি পরিবারকে উন্নত চুলা তৈরি প্রশিক্ষণ ও একটি করে চিমনি (পাইপ) উপকরণ সহায়তা করা হয়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত খোলামেলা জায়গায় অনেক জায়গা নিয়ে বসত বাড়ি হয়ে থাকে সেখানে রান্না করার জন্য আলাদা ঘর এর ব্যবস্থা হয়ে থাকে কিন্তু নগর বস্তিগুলোতে জায়গা স্বল্পতার কারণে একই ঘরে থাকা ও রান্না করতে হয়। নগরে জ্বালানি সংকটের কারণে সাধারণত বস্তির মানুষ রান্না-বান্নার কাজে বিভিন্ন গাছের ডাল, লতা-পাতা, খড়, গোবরের তৈরি ঘুটা ইত্যাদি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু সাধারণ চুলায় এগুলো বেশি পরিমাণ লাগে। পাশাপাশি সাধারণ চুলায় ধোঁয়া নির্গমনের পথ উন্মুক্ত থাকায় ঘরের পরিবেশ দূষিত করে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে। শিশু ও মহিলা যারা রান্নার কাজে জড়িত, তারা পুরাতন পদ্ধতির চুলায় রান্না-বান্না করার ক্ষেত্রে দুষণ ও বিষাক্ত পর্দাথের ঝুঁকিতে থাকেন এবং তারা তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করেন। কিন্তু খুব স্বল্প সময় এবং কম খরচে খুব সহজেই একটি উন্নত চুলা তৈরি করা সম্ভব।

প্রস্তুত প্রণালী সর্ম্পকে কবুলজান বেগম বলেন, “প্রথমে এটেঁল মাটি, তুষ, খড় ও পানি দিয়ে মাটি গুলো ভালো ভাবে প্রস্তুত করতে হয়। চুলার আকার ঠিক করে ২ ভাগে ভাগ করে নিয়ে কাদা দিয়ে একটি অংশের ভিটি তৈরি করে নিতে হয়।। ভিটির মাঝে ফাঁকা রাখতে হবে। এটি হচ্ছে মূখ্য চুলা। এবার মূখ্য চুলার পাশে গৌণ চুলা তৈরি করতে হয়, এটি প্রথম গর্তের চেয়ে ছোট হবে। এর উপর মাটির প্রলেপ দিয়ে চুলার আকৃতি তৈরি করে দুই গর্তের মাঝে একটি নালা তৈরি করতে হবে যেন মূখ্য চুলার থেকে গৌণ চুলায় আগুন যেতে পারে। গৌণ চুলার ভিটির ওপর সিমেন্টের পাইপ বসিয়ে দিতে হবে । যার মাধ্যমে ধোঁয়া চালা দিয়ে বাইরে বের করে দিবে এরপর পাইপের মাথায় একটি টুপি লাগিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে উন্নত চুলা।” বস্তিতে পরিবেশবান্ধব চুলা তৈরি র্কমশালায় জ্বালানি সাশ্রয়, ক্ষতকির র্কাবণ নিস্বরণ হ্রাস, ও পরবিশেরে ভারসাম্য রক্ষায় পরবিশে বান্ধব চুলা ব্যবহাররে উপর গুরত্বারোপ করা হয়।

happy wheels 2

Comments