সুফিয়া কামালের পথ ধরে
কাজী সুফিয়া আখ্তার
‘আমি আমার কাজ করে যাব নীরবে, নিঃশব্দে। আমি পথের কাঁটা সরিয়ে যাব” এরপর যারা আসবে যেন কাঁটা না ফুটে তাদের পায়ে, তারা যেন কণ্টকবিদ্ধ পদে পিছিয়ে না পড়ে। ওইটুকু আমি করবো আমার যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে। উল্লেখিত বাক্যগুলো ১৯২৯ সালের ২৩ জুলাই,‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে লেখা এক চিঠিতে সুফিয়া কামাল লিখেছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৮ বছর। ভাবতে অবাক লাগে, সেই সময়ে সেই বয়সেই তিনি স্বীয় ভবিষ্যৎ কর্ম নির্দিষ্ট করে স্বেচ্ছায় নিজ দায়িত্বভার গ্রহণের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে পেরেছিলেন। মানব মুক্তির দিশারী, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেত্রী, অসাম্প্রদায়িক, কবি সুফিয়া কামাল জীবনভর বহুমাত্রিক কর্মের মাধ্যমে সেই দায়িত্ব পালন সত্য করে তুলেছিলেন।
সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কারের কথা তিনি জানতেন। আরো ভালোভাবে জানতেন রক্ষণশীল পরিবারে, সমাজে নারীর পায়ে পায়ে বেড়ী পরানোর কথা, পশ্চাৎপদতার কথা। তাদের শিক্ষার আলোহীন, সম্মান ও মর্যাদাহীন, উর্পাজনহীন চার দেয়ালে ঘেরা সীমাবদ্ধ জীবনের নানাবিধ দুর্দশার কথা। নারী নির্যাতনের কথা। এসবই শৈশবে তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল। প্রতিবাদও শুরু করেছিলেন শিশুকালেই। তখন সমাজে, পরিবারে মেয়েদের পড়ালেখার রেওয়াজ তত চালু হয়নি। অবশ্য মেরী কুক কলকাতায় বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। আঠারো শতকের স্বনামধন্য সমাজ সংস্কারকগণও মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন, শিশুপাঠ্য বই লেখা, স্কুলের ছাত্রী যোগাড় করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মর্তব্য। অন্তঃপুরে মুষ্টিমেয় জমিদার ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৈষ্ণব, ব্রাহ্ম ও হিন্দু মেয়েরা পড়ালেখা শুরু করেছেন। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের বাংলা পড়া ছিল নিষিদ্ধ। নারী জাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন তাঁর জেষ্ঠ্য ভ্রাতার কাছে এবং সুফিয়া কামাল তাঁর মায়ের নিকট বাংলা শিখেছিলেন বাড়ির সকলের অগোচরে। রোকেয়ার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন সুফিয়া কামাল।
১৯১১ সালে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যখন ৫জন ছাত্রী নিয়ে কলকাতায় সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সুফিয়া কামাল একই বছরে ২০ জুন বরিশাল জেলার অন্তর্গত শায়েস্তাবাদে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। উর্দু ছিল এই পরিবারের ভাষা। এই বাড়ির কাজের লোকরা,মাঝি-মাল্লারা বাংলায় কথা বলতো। এই পরিবারে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া, বাংলা পড়া ছিল নিষিদ্ধ। সুফিয়ার বয়স যখন সাত মাস তখন তাঁর বাবা একদিন রাতে গৃহত্যাগ করেন। আর ফিরে আসেননি। তিনি ছিলেন সুফী ঘরানার মানুষ। ফলে মায়ের সাথে আড়াই বছরের বড় ভাইয়ের সঙ্গে তিনি এই বাড়িতেই বেড়ে ওঠেন। শিশু সুফিয়া ভাইদের সাথে মক্তবে যাওয়ার জন্য জিদ ধরেন। তখন তাঁর ¯েœহময়ী মা ছেলেদের পোশাক পরিয়ে তাঁকে কিছুদিন মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি শৈশবে পারিবারিক গন্ডির বিধিনিষেধ ভাঙতে শুরু করেছিলেন। ছোট গল্প ও কবিতা লিখে এবং পত্রিকায় ছাপিয়ে এই ভাঙার পথ আরো প্রশস্ত করেছিলেন। বারো বছর বয়সে নেহাল হোসেন-এর সঙ্গে বিয়ের পরে তিনি এই বাড়ি ছেড়ে বরিশাল চলে যান। এই সময়ে তিনি সুফিয়া এন. হোসেন নামে লিখতেন। পরে স্বামীর সাথেই কলকাতায় চলে যান। এক কন্যা সন্তানের মা হন। এই সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তার পরিচয় হয় এবং নজরুলের সহায়তায় ‘সওগাত’-এ তার কবিতা ছাপা হয়। অকালে স্বামীর মৃত্যু হলে স্বশিক্ষিত এই নারী কলকাতার করপোরেশন স্কুলে কিছুদিন চাকুরি করে সংসার চালান। ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দীনের সাথে তার ভাই-বোনের সর্ম্পক মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল। তার প্রচেষ্টায় কামালউদ্দীন আহমেদের সাথে কবি সুফিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পরে সুফিয়া কামাল নামে সাহিত্য জগতে এবং সমাজসেবায় ব্যাপক পরিচিতি, সম্মান-মর্যাদা লাভ করেন।
কলকাতায় ১৯৪৬ সালে দেশভাগের পূর্বে দাঙ্গা হলে সুফিয়া কামাল একটি আশ্রয় শিবিরে শরণার্থীদের জন্য কাজ করেন। এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেত্রীদের সাথে এবং শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দেশ ভাগের পরে তিনি ঢাকাতে চলে আসেন। এখানে লীলা নাগের সাথে তিনি কিছুদিন কাজ করেন। সুফিয়া কামাল অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। এদেশের ভাষা আন্দোলনে, রাজবন্দীদের মুক্তি আন্দোলনে, শিক্ষা আন্দোলনে, সাহিত্যিক- সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, উনসত্তরের গণআন্দোলনে, ঘাতক-দালাল নিমূল কমিটির আন্দোলনে তিনি ছিলেন সম্মুখ সারিতে। মুক্তিযুদ্ধে তিনি দুই মেয়েকে যুদ্ধে পাঠিয়ে যোদ্ধাদের জন্য চাল-ডাল-ওষুধ-গরম কাপড় সংগ্রহ করে যুদ্ধ শিবিরে পাঠিয়েছেন। নয় মাসে নয়টি কাঁথা সেলাই করেছেন আর লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরী’। বহু পুরুস্কারে পুরুস্কৃত হন। বাংলা একাডেমী কর্তৃক ‘একুশে পদক’ এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে ‘রোকেয়া পদক’ লাভ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
নারীর মানবেতর জীবনের দুর্ভোগ মোচনে তিনি নারীদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি সংঘবদ্ধ শক্তিতে বিশ্বাসী ছিলেন। শিশু ও নারীদের অধিকার রক্ষায় ও বিকাশে ছিলেন সোচ্চার। তিনি নিজে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি (১৯৪৮), ওয়ারী মহিলা সমিতি (১৯৫৪), নারী কল্যাণ সংস্থা (১৯৬৫), ছায়ানট (১৯৬১), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ (১৯৭০),নারী পূর্নবাসন সংস্থা (১৯৭২)সহ আরো অনেকগুলো সংগঠনের আজীবন সভাপতি ছিলেন এবং ‘অরণ্য কন্যারা জাগো’ বলে সমাজের সকল স্তরের মেয়েদের জেগে উঠতে বলেছেন। বলেছেনÑ ‘মেয়েদের স্বাধীনতা কেউ দিয়ে দেবে না।’
সমাজ-প্রগতি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামাল দেখতে ছোটখাট গড়নের ছিলেন কিন্তু তাঁর মেরুদন্ড অত্যন্ত বলিষ্ঠ। সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে দেশ ও জাতিকে অগ্রসর করে নিয়ে যেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে তিনি প্রথম স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। নিয়মিত নামাজ পড়তেন, পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেন, আশি বছর বয়সে রোজা রেখেছেন। কিন্তু তিনি মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তাঁর মায়ায়-ছায়ায় ঘেরা সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা ‘সাঁঝের মায়া’র দরজা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। মানুষের শুভ ও কল্যাণ কামনায় সংসারিক দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি সমাজের হিত সাধনে সদা ব্যস্ত থাকতেন।
২০ নভেম্বর সুফিয়া কামালেল মৃত্যু দিবস। অসাম্প্রদায়িক সুফি চেতনার অধিকারী সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
** ছবি সংগৃহীত।