মানিকগঞ্জের চার জয়িতা’র গল্প
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥
মানুষের জীবনে চলার পথে আসে নানা ধরনের বাধা। কিন্তু তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? অনেকেই আছেন যারা সব বাধা মোকাবেলা করে এগিয়ে যান সামনের দিকে। অর্জন করেন সফলতা। হয়ে উঠেন একজন সংগ্রামী জয়িতা।
নিজের অদম্য মনোবল সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তৃণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা তৈরি করেন। মানিকগঞ্জের ঘিওরের এমনই চার নারী যারা সব ধরনের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সফল হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সমাজে “জয়িতা” নামে।
সরকারের মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক আয়োজনে ঘিওর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরের মানিকগঞ্জ ঘিওরে চারটি ক্যাটাগরিতে চার জনকে জয়িতা নির্বাচিত করা হয়েছে।
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী ইউ.পি সদস্য নাহিদা আক্তার মুকুলী, শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে পিয়ারী বেগম লিমা, সমাজ সেবায় অসামান্য অবদানে রাবেয়া বেগম এবং একজন সফল জননী হিসাবে পূণ্য বেগম জয়িতা নির্বাচিত হোন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই জয়িতাদের জীবনের গল্প শুরু অনেক দুঃখ কষ্ট ও অভাব অনটনের মধ্যে। প্রতিটি ক্ষণে বেড়ে উঠেছেন সংগ্রাম করে। সংসার, স্বামী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অতি দুঃখ কষ্টে তাদের দিন কাটাতে হয়েছে। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে তারা বিভিন্নভাবে ছুঁয়েছেন সফলতার স্তম্ভ।
নাহিদা আক্তার মুকুলী
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ জয়িতা মুকুলী (৪৬)। ২৪ বছর আগে স্বামীর সংসারে আসার পর থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে বহু কষ্টে দিন কেটেছে। তাঁর স্বামী ঢাকায় একটি প্রেসে সামান্য বেতনে চাকুরি করতেন। সংসার চালাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হতো। স্বামীকে সহযোগিতার করার জন্যে ব্র্যাক ঘিওর শাখার থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেন। পরে যক্ষা রোগীদের পরামর্শ, গর্ভবতী মায়েদের এবং শিশুর সেবা- পরামর্শ দিয়ে মাসে কিছু সম্মানী পেতে থাকেন। ঘিওর মহিলা মার্কেটে একটি দোকান বরাদ্দ পান। স¦ামী, স্ত্রী উভয়ই মিলে দোকানটি পরিচালনা করেন, হয়ে উঠেন একজন অনূকরণীয় নারী। যার ফলশ্রুতিতে তিনি ঘিওর সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়। বর্তমানে স্বামী, ছেলে নিয়ে বেশ ভালোই চলছে তাদের সংসার। এই প্রসঙ্গে নাহিদা আক্তার মুকুলী বলেন, “সংসারের অভাব-অনটনই আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। এক সময় আমি যাদের কাছে ছিলাম অবহেলিত, আজ তারাই আমায় আমার কাজের প্রশংসা করছে।”
পিয়ারা বেগম লীমা
শিক্ষা ও চাকুির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী পিয়ারা বেগম লীমা (৪০) উপজেলার দোতরা গ্রামের মো. তৈয়ব আলীর স্ত্রী। তাঁর স্বামী একজন গ্রাম্য পুলিশ। এক মেয়ে ২ ছেলে নিয়ে অভাব অনটনের মধ্যে তার দিন কাটতো। এস.এস.সি পাশ করার পরে ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন তিনি। পাশাপাশি বিকেল বেলায় ২০/২৫ জন ছাত্রছাত্রীকে প্রাইভেট পড়ান। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকায় মেয়েকে বি.এ পাশ করান। তাঁর ছোট ছেলে বর্তমানে ১০ম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে সফলতার সাথে শিক্ষকতা করা পিয়ারা বেগম লীমা জানান, এ পৃথিবীকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে, ছেলে এবং মেয়ে কে সু শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে।
রাবেয়া বেগম
রাবেয়া বেগম ( ৫৫) উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের বড়ভিলা গ্রামের মৃত শাজাহান মিয়ার স্ত্রী। সমাজ সেবায় অসামান্য অবদান রেখেছেন তিনি। ২৫ বছর আগে স্বামী মারা যায়। এলাকার বিভিন্ন সামাজিক কাজ কর্মের পাশাপাশি বহু বাল্য বিয়ে বন্ধ করেন। গর্ভবতী মায়েদের সেবা সহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বড় ছেলে এম.এ পাশ করে চাকুরিতে কর্মরত আছেন। মেয়ে বি. এ পড়াশুনা করেন।
পূণ্য বেগম
পূণ্য বেগম (৫০) একজন সফল জননী। উপজেলার সিংজুরী ইউনিয়নের আশাপুর গ্রামের মো. আঃ সামাদের স্ত্রী। স্বামী বালুর নৌকায় কাজ করে। দুঃখ কষ্টের মধ্যেও হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বড় ছেলে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরি করেন। এ ছাড়া ছোট ছেলে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি-তে ভালো রেজাল্ট করে। বর্তমানে ফরিদপুর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ালেখা করছে। তার বড় ছেলে চাকুরি পাবার পরে ঘুরে গেছে তাদের সংসারের চাকা। এলাকায় তিনি এখন একজন অনূকরণীয় আদর্শ জননী হিসেবেই পরিচিত।
সম্প্রতি ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমা খন্দকারের সভাপতিত্বে সম্প্রতি উপজেলা অডিটরিয়ামে জয়িতাদের সংর্বধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার লিয়াকত হোসেন, বক্তব্য রাখেন ভাইস চেয়ারম্যান জ্যোৎস্না শিকদার, ইউপি চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম টুটুল, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন প্রমুখ।