নেত্রকোনা প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
প্রশিক্ষণ মানুষের সুদুরপ্রসারী চিন্তার জায়গটা সমৃদ্ধ করে তোলে। আর এই প্রশিক্ষণ লাভের আশায় আমি আর আমার দুইজন সহকর্মী অল্পনা রানী ও বিজলী মুন্ডা নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে ৫দিনব্যাপী ২টি বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ লাভের আশায় নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই ৬ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০ টার সময়। পরদিন বিকাল ৪টার সময় নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় বারসিক অফিসে পৌছাই। মূলত ১ থেকে ৩ ডিসেম্বর এই তিনদিন প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক কর্মশালা এবং ৪ থেকে৫ ডিসেম্বর এই দুই দিনব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও জেন্ডার সক্ষমতা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম কর্মশালার ১ম দিনে প্রথমে সকল অংশগ্রহণকারী এলাকাভিত্তিক পরিচয় পর্বের মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার শুভ সুচনা করেন বারসিক’র এলাকা সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান। কর্মশালায় দেশের ৪টি কর্মএলাকার বারসিক’র কর্মরত স্টাফ ও কমিউনিটি প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। এলাকাভিত্তিক পরিচয়কালীন সময়ে নেত্রকোনা পাহাড়, হাওর, গান, রাজশাহী খরা, আম, তেতুল, মানিকগঞ্জ সমতল, নদী, গাজর, লালন এবং সাতক্ষীরা লবণাক্ততা, বাঘ, কাঁকড়া, মধু কেওড়া প্রভৃতি পরিচয় তুলে ধরেন অংশগ্রহণকারীরা। এসময় প্রশিক্ষক সৈয়দ আলী বিশ্বাস ৪টি এলাকার ভিন্ন বৈচিত্র্য ও পারস্পারিক আন্তঃসম্পর্কসমুহ তুলে ধরেন।
প্রথম দিনের কর্মশালার মূল বিষয় ছিল প্রতিবন্ধী মানুষ। এদিন সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে প্রশিক্ষক হিসেবে উপস্থিত হন প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের নেত্রকোনা জেলা কর্মকর্তা সঞ্জীব চক্রবতী। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের চিন্তা এবং আমাদের করণীয় এবং আমাদের সমাজে তাদের অবদান বা মূল্যায়নের জায়গাসমুহ আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার অনেক বেশি সচেতন ও নানামূখী উন্নয়ন কাজ চলমান রেখেছেন। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আওতায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র, জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় প্রতিবন্ধী ডিভলপমেন্ট সুরক্ষা কল্যাণ ট্রাস্ট তিনটি শাখা কার্যকরভাবে কাজ করছে। আবেদনের প্রেক্ষিীতে নগত এককালীন অর্থ সহযোগিতা করে থাকে। প্রতিবন্ধী ব্যাক্তিদের জন্য ৩২টি মোবাইল ভ্যান তৈরি করা হয়েছে। যার প্রতিটি মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।’
এদিন বিকালে নেত্রকোনা জেলা ফিজিও থেরাপিষ্ট ডা. মোস্তাফিজুর রহমান প্রশিক্ষকের ভূমিকায় হাজির হন। এসময় তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কিভাবে ফিজিও থেরাপী দেওয়া হয় সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও ব্যাখা করেন। চিত্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী’র প্রকার ও মাত্রা তুলে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সুবর্ণ নাগরিক হিসেবে সমাজ উন্নয়নের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ৮ ধরনের সহায়ক উপকরণ সহযোগিতা করা হয়। এছাড়াও প্রতিবছর নভেম্বর মাসে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য চাকরি মেলার আয়োজন করে।’ সবশেষে সারাদিনের ফিডব্যাক আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রথম দিনের সমাপ্তি ঘটে।
প্রথমম কর্মশালার ২য় দিনের শুরুতে ১ম দিনের সার সংক্ষেপ তুলে ধরেন রাজশাহী অঞ্চলের তহুরা খাতুন লিলি ও সাতক্ষীরার মননজয় মন্ডল। এদিনের বিষয় ছিল প্রবীণ ব্যাক্তি। এদিন উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ হিতোষী সংঘের জেলা সাধারণ সম্পাদক সায়েদুর রহমান। তিনি প্রবীণ মানুষেরা যে সমাজের বাধা নয় সেটা তিনি আলোচনা করেন। তিনি নিজে একজন প্রবীণ মানুষ হয়েও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। প্রবীণ হিতোষী সংঘ কিভাবে প্রবীনদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করছে সেটি তুলে ধরেন। দুপুরে খাবার পর বারসিক’র কর্মকর্তা শংকর ¤্রং প্রবীণ অধিকার নীতিমালা ২০১৩ ও পিতামাতার ভরণ পোষণ আইন ২০১৩ বিষয়ে সাবলীল আলোচনা করেন। এরপর প্রোগ্রাম অফিসার আলমগীর হোসেন প্রবীণ অজ্ঞিতার একটি দলীয় অনুশীলন পরিচালনা করেন। এসময় ২ দিনের সার সংক্ষেপ তুলে ধরেন মানিকগঞ্জের বাদল রহমান।
প্রথম কর্মশালার সমাপনী দিনে একটি অভিজ্ঞতা সফরের (পাহাড়, নদী, হাওর, জাতি গোষ্ঠী ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ও বাংলাদেশ ও ভারতীয় সীমানা, লবণ চা, প্রাণ প্রকৃতি ও বৈচিত্র্য প্রভৃতি দর্শনের মধ্য দিয়ে কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপড়া গারো উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামে একটি দলীয় অনুশীলনের আয়োজন করা হয়। যেখানে ৫ এলাকাভিত্তিক প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজিক বাধা ও উত্তরণের উপায়সমূহ তুলে ধরা হয়।
২য় কর্মশালার ১ম দিন (৪ডিসেম্বর ২০১৯ বুধবার) প্রমিক্ষণ কর্মশালার মূল সহায়ক বারসিক’র পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস জলবায়ু পরিবর্তন ও জেন্ডার বিশ্লেষণ বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক ধারণাসমূহ আরো স্পষ্ট করার জন্য সরসরি হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এসময় আবহাওয়া, জলবায়ু, আপদ, বিপদ, ঝুঁকি, বিপদাপন্নতা, সক্ষমতা, অভিযোজন, প্রশমন, জ্বালানি, পৃথিবী, ভুমন্ডল, ওজনস্তর প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে খুব সাধারণ উদাহরণ ও ব্যাখার মাধ্যমে আলোচনা ও বর্ণনা করেন। বারসিক নেত্রকোনা অফিসের দুই জন কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার লিটা ও পার্বতী রানী সিংহ জেন্ডার এর সামাজিক ও শারীরিক পরিচিতি আলোচনা করেন। কর্মশালার সমাপনী দিনে এলাকাভিত্তিক ৫টি দলীয় অনুশীলনী ও উপস্থাপন করা হয়। মঙ্গল আরতির গান দিয়ে শুরু হওয়া প্রশিক্ষণ কর্মশালার সফল সমাপ্তি ঘোষণা করেন বারসিক’র এলাকা সমন্বয়কারী অহিদুর রহমান।
কখন নাচ, কখনও গান আবার মাঝে মাঝে অভিনয় ও কবিতা আবৃতির মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী ২টি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। আর এই আনন্দ বিনোদনের মধ্য দিয়ে শিখনের প্রতিটি বিষয় অংশগ্রহণকারীর হৃদয়ে এমনভাবে স্থান পেয়েছে, যার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান থেকে কার্যকরী সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে তারা মনে করেন।