একজন শ্রেষ্ঠ পিতা
:: নেত্রকোনা থেকে মো. আলমগীর::
একজন আঃ সাত্তারের কথা
সন্তানরা যখন ভালো পথে চলে, প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পিতামাতাদের গর্ব হয়, মানসিকভাবে পরিতৃপ্ত হয়। কারণ প্রতিটি পিতামাতাই চান তাদের সন্তানকে শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে। এজন্য তাঁরা নানাভাবে চেষ্টা করেন। সন্তানদের জন্য তারা আত্মত্যাগ করেন। পিতামাতারা যখন সন্তানের পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেন সমাজে, রাষ্ট্রে তখন এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। এক্ষেত্রে পিতামাতারও অনেক দায়-দায়িত্ব পালন করতে হয়। সন্তানকে সুপথে পরিচালনা, শিক্ষিত করে তোলা এবং তাদের ভেতরে মানবিক গুনাবলী বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে হয় পিতামাতাকে। তবেই না সন্তানরা সক্রিয় ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। আজ আমরা এরকমই একজন পিতার কথা বলছি। যিনি তার শ্রম, আন্তরিকতা, দৃঢ়তা ও মনোবল দিয়ে দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতাকে জয় করে সন্তানের শিক্ষিত করে তুলেছেন, সুপথে পরিচালিত করেছেন। তার সন্তানের পরিচয়ে আজ তিনি সমাজে পরিচিতি। এরকমই একজন পরিতৃপ্ত ও গর্বিত পিতা অভয়পাশা বাজারের সুপারির বিক্রেতা প্রান্তিক কৃষক আব্দুল ছাত্তার। ১৯৪৫ সালে আটপাড়া-স্বরমুমিয়া ইউনিয়নের দূর্গাশ্রম গ্রামে কৃষক আব্দুর রহমানের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন তিনি। অভাব-অনটনের কারণে তিনি নিজে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে না পারলেও মানবিক শিক্ষায় তিনি সমৃদ্ধ। তাই তো তিনি তার প্রতিটি সন্তানকে হাজারও কষ্ট ও অভাবের মধ্যেও শিক্ষিত করে তুলেছেন। তার এ উদ্যোগ, প্রচেষ্টা, আত্মত্যাগ এবং পরিশ্রম গ্রামে অনন্য পরিচিতি তুলে ধরেছে। তার গ্রাম দূর্গাশ্রমে গেলে তার সেই পরিচিতিটা পাওয়া যায়। এই গ্রামের একটি শিক্ষিত ও আদর্শবান পরিবারের কথা জানতে চাইলে সবাই সুপারি ব্যবসায়ী আ: ছাত্তারের কথা বলেন।
আঃ সাত্তারের জীবন সংগ্রাম
দুই ছেলে, ছয় মেয়ে ,স্ত্রী ও ছোট ভাই মিলে আব্দুস সাত্তারের ১১ সদস্যের সংসার। তাঁর মোট জমির পরিমাণ ৯২ শতাংশ। এর মধ্যে বতসভিটা ৪২ শতাংশ এবং আবাদী জমি ৫০ শতাংশ। এসব জমি থেকে যা উৎপাদন হয় এবং সুপারি ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চালান তিনি। কৃষিকাজ ও দিনমজুরি করেই তিনি বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেন। এ জীবন সংগ্রামে তার একমাত্র সম্বল ছিলো বাবার সহযোগিতা। আনুমানিক ১৮/২০ বছর বয়সে পাশের পাড়ার রহিমা আক্তারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার শুরু করেন তিনি। বিয়ের কিছুদিন পরেই মারা যান তার পথপ্রদর্শনকারী পিতা। দুই ভায়ের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা বিয়োগ হওয়ার পর আব্দুস সাত্তারকে বইতে হয় সংসারের হাল। কেননা তার ছোট ভাই একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। স্ত্রী, সন্তান, ছোট ভাই ও মায়ের দেখভাল তাকেই করতে হয়। নিজস্ব জমিজমা কম থাকায় অভিভাবকহারা এই মানুষটি সংসার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত হন। কিন্তু কোন ব্যবসায় সফলতা অর্জন করতে পারেননি। সর্বশেষ একজন প্রবীণ ব্যক্তির পরামর্শে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সুপারি ক্রয় করে তা পার্শ্ববর্তী অভয়পাশা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। এখনও সেই সুপারি ব্যবসায়ীর সাথেই তিনি জড়িত। এত বড় একটি পরিবারের দেখভাল ও খোরাক যোগানোর কাজ কষ্ট হলেও তিনি কিন্তু সন্তানদেরকে নিরক্ষর রাখেননি।
সন্তানদেরকে শিক্ষিত করে তোলার প্রতিজ্ঞা
আঃ সাত্তার নিজে পড়ালেখার সুযোগ পাননি বলে অভাব অনটনের সংসারে অতি কষ্টেও তার সব সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করার প্রতিজ্ঞা করেন। তার এই প্রতিজ্ঞাই তাকে সাহস যুগিয়েছে, শক্তি দিয়েছে। প্রতিটি সন্তানকে তিনি শিক্ষার আলো দিয়েছেন। এভাবে দেখা যায়, তাঁর চতুর্থ সন্তান মেয়ে তেলিগাতী ডিগ্রী কলেজ থেকে বিএ পাস করে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে এম এ অধ্যায়নরত। ৫ম মেয়ে স্থানীয় স্কুল ও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ৬ষ্ঠ মেয়ে স্থানীয় তেলিগাতী ডিগ্রী কলেজে বিএ অধ্যয়নরত। ৭ম সন্তান ছেলে স্থানীয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে নেত্রকোণা সরকারি কলেজে বিএ অধ্যয়নরত। ৮ম সন্তান মেয়ে স্থানীয় স্কুলে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। এছাড়াও তাঁর প্রথম সন্তান মেয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। দ্বিতীয় সন্তান ছেলে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে অভাব অনটনের সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করা এবং ছোট ভাই বোনদের লেখাপড়া করানোর জন্য ঢাকায় চাকুরি করেন। তাঁর তৃতীয় সন্তানও এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়-এর অবস্থা সেই পরিবারের প্রতিটি সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার কাজটি নিশ্চয়ই খুব কঠিন ছিলো। কিন্তু এ কঠিন কাজকেই সহজ করে তুলেছেন আঃ সাত্তার তার দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস দিয়ে।
আঃ সাত্তারের ভাষ্য
বাবা মারা যাওয়ার পর জমি চাষ, মানুষের বাড়িতে শ্রমবিক্রি ও সুপারির ব্যবসায় উপার্জিত টাকায় সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, বই পুস্তক ক্রয় এবং সন্তানদের স্কুলের খরচ যোগিয়েছেন। মাঝে মাঝে উপার্জিত টাকায় সংসার চালাতে না পেরে ক্রমান্বয়ে আবাদী জমিগুলো বিক্রি করে সন্তানদের পিছনে খরচ করেন। তবে এতে তাঁর কোন আপসোস নেই। কারণ সন্তানরা শিক্ষিত হয়েছে এটাই তাকে পরিতৃপ্তি দিতো। তিনি বলেন, “কোন প্রয়োজনে স্কুলে গেলে অন্য ছেলেমেয়েদের পরনে ভালো ভালো জামাকাপড় দেখে খুবই খারাপ লেগেছে কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় বাচ্চাদের বুঝিয়েছি, শান্ত¦না দিয়েছি। তবে বিধাতার নিকট আমি কৃতজ্ঞতা জানাই যে, আমার সন্তানরা কোন দিন আমার নিকট এমন কিছু চায়নি, যা আমি তা দিতে পারবো না।” তিনি আরও বলেন, “সন্তানরা আমার কষ্টের অংশীদার হিসেবে নিরবে পড়ালেখা চালিয়েছে। আমার অধিকাংশ সন্তানই মেধাবী। তারা বৃত্তি পেয়েছে। লেখাপড়ার খরচের ক্ষেত্রে আমি হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু, শাকসবজি বিক্রি এবং ব্যবসায় উপার্জিত টাকা থেকে পেয়েছি।” তিনি বলেন, “আমার সব সন্তানই শান্ত সভাবের। ফরম ফিলাপের সময় একই সাথে তিন চার জন সন্তানের খরচ যোগাতে খুবই কষ্ট হয়েছে কিন্তু কারো নিকট কোন দিন কোন ধরনে সহায়তার জন্য হাত পাতিনি। তবে কেউ যদি স্বদিচ্ছায় সহায়তার হাত বাড়ান তাতে আমি ‘না’ করিনি। এ সহায়তা পেয়ে আমার তো ভালোই লেগেছে। সহায়তাকারীদের কথা আমি আজীবন মনে রাখি।” আঃ সাত্তারের ভাষ্যমতে, গ্রামের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি অসহায় দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ান তাহলে সমাজের অনেক ছেলেমেয়ে শিক্ষিত হতে পারে, হতে পারে প্রকৃত আলোকিত মানুষ।
আঃ সাত্তারের স্বপ্ন ও চাওয়া
আঃ সাত্তার স্বপ্ন দেখেন দেশ থেকে দুর্নীতি থাকবে না। কেউ ঘুষ দিয়ে চাকুরি নেবে না। ঘুষ দিয়ে চাকুরি না ঢুকলে কেউ ঘুষ খাবে না। এতে করে সমাজে দুর্নীতি থাকবে না। সততার চর্চা হবে সর্বক্ষেত্রে। তিনি বলেন, “আমি আমার সন্তানকে ঘুষ দিয়ে চাকরি নিতে দিব না। কারণ ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলে তারাও ঘুষ খাইবো, দূর্নীতি করবো। দুর্নীতির কারণে সমাজের মানুষ অনেক কষ্ট করে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে পারলে আমাদের মত ভূমিহীন এবং প্রান্তিক কৃষকদের এত কষ্ট করতে হইব না।” তিনি আরও বলেন, “প্রয়োজনে আমি সন্তানদেরকে বলবো প্রাইভেট পড়িয়ে সৎভাবে সংসার চালাতে। কোনভাবে তাদেরকে দুর্নীতি করতে দেবোনা। সৎভাবে ব্যবসা করলে, সৎ পথে চললে মানুষ তাদের ভালো কইব। মানুষ কইবো আঃ সাত্তারের সন্তানেরা ঘুষ খায় না। তারা সৎ। এতেই আমি খুশি হবো।” এলাকার মানুষ আমাকে ভালো করলেই খুশি হন তিনি। তিনি তার এলাকার প্রতিটি অভিভাবকের প্রতি আহ্বান জানান সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার। তাঁর মতে, “আমার মত অসহায় অভিভাবকরা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষের মত মানুষ বানিয়ে সমাজের দুর্নীতি, অন্যায় অত্যাচারের বোঝা কমিয়ে সুন্দর ও শান্তিপুর্ণ সমাজ গড়তে পারে।”