শুধু লবণ পানিই আছে!

সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল

‘মানুষ পানি পান করে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য। আর আমরা পানি খাই শুধু জান বাঁচানোর জন্য। আগে আমরা আমাদের এলাকার আমাদের বাড়ির আশেপাশের যেকোন পুকুর থেকে পানি নিয়ে খেতাম। এতে করে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হতো না। এলাকাতে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে কম-বেশি করে নানান ধরনের গবাদি পশু পালন করতাম। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে আর এর মুল কারণ হলো লবণ পানি। এখন এলাকার প্রায় সব খাল, পুকুরে লবণ পানি। এছাড়াও লবণ পানি উঠিয়ে চিংড়ি চাষ করার কারণে একেিদক যেমন কৃষি জমি কমে যাচ্ছে সাথে আমাদের মিষ্টি পানির আধার কমে যাচ্ছে। পানির জন্য বিশেষ করে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার করতে হচ্ছে। এদিকে এলাকার যে দিকে তাকাই না কেন শুধু পানি আর পানি কিন্তু তা শুধু লবণ পানি।’


উপরোক্ত কথাগুলো বললেন কাশিমাড়ি ইউনিয়নের শংকরকাটি গ্রামের কৃষানী মীনা বেগম। গতকাল বিকালে শংকরকাটি কৃষি নারী সংগঠনের উদ্যোগে ও বারসিক’র সহায়তায় কৃষাণী নাজমা বেগমের বাড়িতে এলাকার পানীয় জল ও এলাকার পানির পরিস্থিতি নিয়ে গ্রাম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন তিনি।


আলোচনা সভায় শংকরকাটি গ্রামের কৃষাণী, শিক্ষার্থী ও বারসিক কর্মকর্তাসহ ১৭ জন নারী ও ২ জন পুরুষ সহ মোট ১৯ জন অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভায় অংশগ্রহনকারীদের নিকট তাদের এলাকার পানির পরিস্থিতি কেমন? কি ধরনের সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে? সমস্যা সমাধানের তাদের উদ্যোগ ও পরামর্শ জানার চেষ্টা করা হয়।


সভায় অংশগ্রহণকারী নারী উষা রানী দাস, জুলেখা বেগম ও জাহিমারা বলেন, ‘আমরা এখন সরাসরি পুকুরের পানি, বর্ষার সময় বর্ষার পানি সংরক্ষণ, পানি ক্রয় করে ও দূরবর্তী স্থান থেকে পানি সংগ্রহ করে সুপেয় পানির সমস্যা মিটাচ্ছি। এছাড়া অনেকসময় দূর থেকে পানি ক্রয় করে সে পানির সাথে বাড়ির পুকুর ও টিউবওয়েলের লবণ পানি মিশ্্িরত করে খাই। আমার জানি যে আমাদের এ পানি খাবার উপযোগী নয়। এ পানি খেলে আমাদের শরীরের নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারপরও কোন উপায় না দেখে জীবন বাঁচানোর জন্য এ পানি খাই।’ তারা আরও বলেন, ‘আমাদের এখানকার বেশির ভাগ মানুষ পুকুরের পানির উপর নির্ভরশীল। কারণ আমাদের নিচের পানি ভালো না। তার পরেও কিছু পরিবারে টিউবওয়েল বসিয়ে সে লবণ পানি খাচ্ছেন। পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে বেশ একটা খরচ হয় প্রতিমাসে। পানি সংরক্ষণের জন্য ড্রাম, গাজী ট্যাংক, প্লাস্টিকের নানা ধরনের পট ও বোতল, বালতি, কলস ও মাটির মেটে পানির সংরক্ষণ কাজে ব্যবহার করি। আর পানির সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ বেশিটা আমরা নারীরা করি। আগেও আমরা পুকুরের পানি খেতাম কিন্তু তাতে খুব বেশি সমস্যা হতো না।’
প্রায় একই কথা জানান নাজমা বেগম। তিনি বলেন, ‘যে কোন সমস্যা হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। কিন্তু ডাক্তার আমাদের বেশি বেশি করে পানি খাওয়ার পরামর্শ দিই কিন্তু আমাদের পানির সংকট দেখে আমাদের পানির খাওয়ার পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আগে যখন দিনে ১২ লিটার পানি ব্যবহার করি আর এখন সেখানে প্রায় ৭-৮ লিটার পানি ব্যবহার করি। এলাকায় লবণ পানি প্রবেশের পর থেকে আমাদের এরকম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এখন যেন ঘরে ঘরে রোগ লেগে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভালো পানি না থাকার কারণে নানাণ ধরনের রোগ ব্যাধি হচ্ছে যেমন গ্যাস বেড়ে যাচ্ছে, ডায়েরিয়া, পাতলা পায়খানা, মাথা ঘোরা, হাত পা ঝিনঝিন করা, মাথায় চাপ ধরা, এলার্জি, চুলকানি, পাচড়া রোগ। এছাড়াও গবাদি পশুর ও নানান ধরনের রোগ বালাই হচ্ছে পচা পঞ্চমী, কৃমি, রানী ক্ষেত, আমাশয় ইত্যাদি রোগ।’ তিনি জানান, এলাকাতে পানির জন্য গবাদি পশুও কমে যাচ্ছে, কৃষি কাজ করতে পারছে না, আগে জমিতে বা বাড়ির ভিটায় নানান ধরনের শাকসবজি চাষ হতো তা আর হচ্ছে না। সব কিছু যেন কমতে শুরু করেছে। আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু তার সাথে প্রকৃতির সব সম্পদ কমতে শুরু করেছে তা আর বাড়ছে না।


অংশগ্রহণকারীরা তাদের এলাকার সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেরা কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা জানান এবং কিছু সুপারিশ করেন। এলাকায় যারা সম্পদশালী ব্যক্তি আছেন তারা যদি কোন সুপেয় পানির পুকুর খনন এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন, সাথে যে খালগুলো আছে সেখানে মিষ্টি পানির আধার তৈরি করা করা যায় তাহলে পানি সঙ্কট কিছুটা হলেও লাঘব হতো বলে অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন।

happy wheels 2

Comments