কৃষি বীমা করা হলে কৃষকরা সত্যিকারেই উপকৃত হবে
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বারসিক ও নেত্রকোনা জেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটির আয়োজনে সম্প্রতি মদন উপজেলা পরিষদ পাবলিক হলে “হাওরে বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়” শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার অয়ালীউল হাসানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আকন্দ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম রসুল, যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইলিয়াস আহম্মেদ, জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছায়েদুর রহমান, গোবিন্দশ্রী ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম। অন্যান্যদের মধ্যে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, শিক্ষক ও দু’টি ইউনিয়নের কৃষক প্রতিনিধিসহ মোট ৪০ জন উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময় সভায় বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী অহিদুর রহমানের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বারসিক’র সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ম্রং। ফসল বিপর্যয় ও হাওরের জীবন বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে কৃষকদের স্বার্থে ১৪টি দাবি সম্বলিত দাবি তুলে ধরেন নেত্রকোনা জেলা জনসংগঠনের সভাপতি কৃষক সায়েদ আহমেদ খান বাচ্চু।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার অলিউল হাসান প্রধান অতিথির বক্তব্যে ‘হাওরে বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়’ বিষয়ে মতবিনিময় সভা আয়োজনের জন্য বারসিককে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘এই মতবিনিময় সভার ফলে কৃষকরা তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন এবং কৃষকদের সমস্যা সমাধানে করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইকোসিস্টেম ঠিক না থাকায় এধরণের সমস্যা হচ্ছে। ইকো সিস্টেমের ব্যাঘাত ঘটায় জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রকৃতির উপর। তাই আমাদের সবাইকে এখনই প্রকৃতিকে নিয়ে ভাববার এবং প্রকৃতিকে ঠিক রেখে সচেতনতার সাথে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন,‘আমাদেরকে নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে স্থানীয় ও আধুনিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কাজ করতে হবে তবেই আমাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে।’
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষকদের সমস্যার সঠিক কারণ চিহ্নিত করে এর সুষ্ঠ সমাধানে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতার জন্য কৃষি বিভাগকে আহবান জানান। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইলিয়াস আহম্মেদ কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে বলেন, ‘সরকার ধান ক্রয়ের জন্য নতুন মূল্য নির্ধারণ করলেও উপজেলা পর্যায়ে এখনও বরাদ্দ আসেনি। বরাদ্দ পাওয়া গেলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে আলোচনা করে ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হবে।’ জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রতিনিধি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘ধানের ব্যাপক চিটা হওয়ার যেসব কারণ কৃষকরা, কৃষি বিভাগ ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছেন তার কোন ভিত্তি নেই। তাই সঠিক গবেষণার মাধ্যমে এর কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’ গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আগাম ধান রোপণ, অধিক সার ব্যবহার, বীজের সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণকে ফলন বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু এর সঠিক কারণ এখনও অজানা।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম রসুল বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়ের বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে বলেন, ‘ধানে চিটা হওয়ার ঘটনা হাওরাঞ্চলে এটিই প্রথম নয়, এর আগেও ২০১৮ সালেও ব ্যাপক চিটা হয়েছিল। আর কৃষির এসব সমস্যা নিয়ে গবেষণা করা কৃষি বিভাগের কাজ নয়, এটি মূলত ধান গবেষণা কেন্দ্রের কাজ। গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হল কৃষি বিভাগের কাজ। ধানে চিটা হবে এটিই স্বাভাবিক, তবে এর হার হবে সর্বোচ্চ ২০%।’ তিনি হাওরে কৃষির দু’টি সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আগাম লাগালে চিটা হবে আর ে দরিতে রোপণ করলে বন্যায় পাবে। বীজতলায় বীজ বপন থেকে ধানের জীবনকাল শুরু হয়। এবছর তাপমাত্র বেশি থাকায় চারা রোপণের এক সপ্তাহের মধ্যেই চারা সজীব হয়ে উঠে, ফলে জীবনকাল এগিয়ে আসে। কিন্তু ধান যখন থোর/গর্ভে আসে এবং শীষ বের হওয়ার সময়ে ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিক পর্যন্ত বৃষ্টি ও ঠান্ডার জন্য ধানে চিটা হয়েছে।’’ ধান গবেষণা কেন্দ্রের দেয়া তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মূলত ঠান্ডা বা কোল্ড ইনজুরীর জন্যই ধানের চিটা হয়েছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ সপ্তাহে বীজতলা করে তার ৩০-৪০ দিন পর চারা রোপণ করলে কোল্ড ইনজুরীর সমস্যা হবে না।’ তিনি ব্রি-৮৬, ব্রি-৮১ ধান ফলন ভালো ও আগাম হওয়ায় ব্রি-২৮ এর পরিবর্তে এগুলো চাষ করার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘হাওরের কৃষকরা বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে বেরো মৌসুমে ধান ফলায় এবং মাঝে মাঝেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি উন্নত পদ্ধতিতে কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান ও কৃষি প্রযুক্তি প্রদানের জন্য কৃষি বিভাগকে অনুরোধ জানান। তিনি খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরকে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে ধান ক্রয় করে ধানের ন্যায্যমূল্য পেতে কৃষকদের সহযোগিতা করে ক্ষতি কিছুটা হলেও লাঘবের অনুরোধ জানান।
স্বাগত বক্তব্যের পর অংশগ্রহণকারী কৃষক, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (মেম্বার), গণমাধ্যম কর্মীগণ হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের ফলন বিপর্যয় বিষয়ে নিজ নিজ মতামত তুলে ধরেন। গোবিন্দশ্রী কৃষাণী বেদেনা আক্তার বলেন, ‘আমি চলতি বোরো মৌসুমে এক আড়া (১৬০ শতাংশ) জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করে ১০ মণ ধান পেয়েছি, যেখানে মোটামুটি ফলন হলেও ৭০-৮০ মণ ধান হবার কথা। ধানের শীষ বের হলেও শীষ খাড়া ছিল, নোয়ায়নি।’ কৃষক আব্দুল হেলিম বলেন, ‘আমি ধার দেনা করে ৩০ কাঠা (৩ একর) জমিতে ব্রি-২৮ ধানের চাষ করে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বোরো চাষ করে আমি এখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।’ মদন প্রেস ক্লাব সভাপতি সাংবাদিক আল আমীন বলেন, ‘সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করে দেখেছি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্রি-২৮ ধানের। ব্রি-২৮ জাতের পরিবর্তে ব্রি-৫৮ জাত চাষ করেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা।’ তিনি হাওরাঞ্চলে ব্রি-৫৮ জাতটি সম্প্রসারণ না করার জন্য কৃষি বিভাগকে অনুরোধ জানান। কৃষক রকুনুদ্দিন তালুকদার, রইছউদ্দিন, আব্দুল কাদির, কৃষাণী পান্না আক্তার, জাহাঙ্গীর আলম, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি কদ্দুস মেম্বারসহ উপস্থিত কৃষকরা বোরো ধানের ফলন বির্পযয়ের চিত্র তুলে ধরেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা ব্রি-২৮ বিকল্প ধানের জাত হাওরাঞ্চলের সম্প্রসারণের জন্য কৃষি বিভাগের সহযোগিতা কামনা করেন। উপস্থিত কৃষকরা সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে ধান ক্রয়ের জন্য সরকারের খাদ্য বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এটি করা হলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে এবং কৃষকদের ক্ষতি কিঠুটা হলেও কমবে।
কৃষক সংগঠনের লিখিত দাবিগুলোর মধ্যে কৃষি বীমার দাবিটি সমর্থন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষি বীমা/শস্য বীমা করা হলে কৃষকরা সত্যিকারেই উপকৃত হবে। তবে এক্ষেত্রে কৃষকদেরকে সচেতনতার সাথে বীমা করতে এগিয়ে আসতে হবে।” তিনি প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এধরণের মতবিনিময় সভা আয়োজন করে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের প্রস্তাব করেন। এজন্য তিনি বারসিক সংগঠনকে উপযুক্ত বলে মনে করেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে ধান চাষ করলে হয়তো এধরণের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাওরের বোরো ধানের ফলন বিপর্যয়ের বিষয়টি জেলা ও বিভাগসহ উর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করা হয়েছে। প্রণোদনার জন্য বরাদ্দ পেলেই তা’ কৃষকদের মধ্যে সঠিকভাবে পৌছে দেয়া হবে।” কৃষি নির্ভর সঠিক জ্ঞান অর্জন করে কৃষি কাজ করলে কৃষি সমস্যাগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।