সাম্প্রতিক পোস্ট

নারীবান্ধব আশ্রয়কেন্দ্র চাই-অঞ্জলী রাণী

সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদার

বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রাকৃতিক ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ উপকূলীয় সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। তবে, দুঃখজনক হচ্ছে, মোট জনসংখ্যার তুলনায় উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খুবই নগণ্য। তাই দূর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া নারী, শিশু ও প্রবীণদের জীবনে শুরু হয় মানবতাবিবর্জিত অন্য আর একটি দুর্যোগ। দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবতাবিবর্জিত দুর্যোগের শিকার হন অঞ্জলী রাণী ম-ল। তিনি আইলা জলোচ্ছ্বাসের পর আশ্রয়কেন্দ্রের স্মৃতিচারণ করে নারীদের দুঃখ কষ্ট ও বেদনার দূর্বিসহ কাহিনী তুলে ধরেছেন।
6
অঞ্জলী রাণী থাকেন উপকূলীয় পদ্মপুকুর ই্উনিয়নের ঝাঁপা গ্রামে। দুর্যোগকালীন সময়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ভেড়ি বাঁধ ভেঙে যখন পানি আসতে লাগল তখন আমরা শুকনো খাবার, চাল, ডাল ও প্রযোজনীয় কাগজপত্র, গহনা গুছিয়ে ঝাপা আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে উঠি। ঘরের সবকিছু গুছিয়ে আমার স্বামী ও শশুর এর কাছে দিলে তারা সেগুলো আশ্রয় কেন্দ্রে রেখে আসেন। তারপর আমি ও আমার শাশুড়ী যেয়ে উঠি। ঐ রাতগুলোতে ঘুমাতে পারতাম না। নারী-পুরুষ সবাই এক ঘরের ভিতর থাকতে হত।” তিনি আরও বলেন, “নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে কোন আলাদা থাকার ব্যবস্থা নেই। আমাদের সাথে ৩ জন গর্ভবতী নারী ছিল। তারা পুরুষদের সামনে যেতে লজ্জা পেত। হঠাৎ দুর্যোগ আসায় অনেকেই কাপড় চোপড় গুছিয়ে আনতে পারেনি। পুরুষদের সামনে দিয়ে বাথরুমে যেতে লজ্জা লাগত। লজ্জার কারণে অনেক নারী বাথরুম চেপে রাখত। যার ফলে পরবর্তীতে নারীদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়।”

তিনি জানান, দুর্যোগের সময় নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। দুর্যোগের সময় সবার শেষে নারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়। আশ্রয় কেন্দ্রে নারী ও শিশুদের সমস্যার শেষ নেই। প্রথমে সমস্যায় পড়তে হয় পয়ঃনিষ্কাশনের। শিশুদের একই সমস্যা নিয়ে বিপদে পড়েন মায়েরা। বেশির ভাগ আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মানুষের তুলনায় ছোট ও কম জায়গা। যে কারণে সারাক্ষণ শিশুদের উপর নজরদারি করা সম্ভব হয় না। পানিতে ডুবে অনেক শিশু মারা যায়। অঞ্জলী রাণী বলেন, “রাতে নারীরা বেশি ভয়ে থাকতো সম্ভ্রম হারানোর। আশ্রয় কেন্দ্রে ভালো মত ঘুমাতে পারতাম না। রান্না করে যার যার পরিবার খেত। তবে চুলার সংকটে এক এক জন করে রান্না করত। নদী থেকে ভেসে আসা কাঠ ধরে রান্না করা হত। তাই পানি কমার সাথে সাথে বাড়ির সবাই মিলে রাস্তার উপর ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করি। এইভাবে রাস্তার উপর এক বছর ছিলাম। তারপর বসতভিটা ঘর ঠিক ফিরে আসি”।
7
দুর্যোগে নারীর দূর্ভোগের কাহিনী এখানেই শেষ নয় বলে অঞ্জলী রানী আরো জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুরুষকে জীবিকা অর্জনের জন্য অন্যত্র চলে যেতে হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির দায়িত্ব পড়ে নারীর উপর। স্বামীর সাথে ঠিকমত যোগাযোগ হয় না। এর ফলে মানসিক চিন্তায় থাকতে হয়। পারিবারিক বন্ধন ক্ষীণ হতে থাকে। কখনও সংসারের খরচ পাঠাতে দেরি হয়। নারীকে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পরিবারের খাবার তৈরি এবং খাবার পানি সংগ্রহে নারীদের চরম কষ্ট করতে হয়। নারী অধিক পরিশ্রম করে কিন্তু কম পানি পান করে। ফলে নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক সময় সুপেয় পানির অভাবে লবণ পানি পান করতে হয়। ফলে নারীরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। তিনি বলেন, “গর্ভাবস্থায় মা লবণ পানি পান করায় শিশু স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রাকৃতিক  দুর্যোগের সতর্ক সংকেত দিলে আতঙ্ক কাজ করে। শুধু মনে হয় আবারও কি ঐ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে। এখন সতর্ক সংকেত দিলে রাতে আমরা পর্যায়ক্রমে জেগে থাকি, রেডিও শুনি এবং খেয়াল রাখি কোথাও মাইকিং করছে কিনা বা কোথাও ভেঙে গেল কি না ইত্যাদি”।

উপকূলের জলবায়ু ঝূঁকির মধ্যে বসবাসকারী নারী ও শিশুদের জীবনের সার্বিক নিরাপত্তায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী শিশুবান্ধব করার জন্য সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ করেছেন অঞ্জলী রাণী। অঞ্জলী রানীর দাবি, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারী ও পুরুষের আলাদা থাকার ব্যবস্থা, খাবারের ব্যবস্থা, টয়লেটের ব্যবস্থা, গোসলের ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে তাঁর প্রত্যাশা গর্ভবতী নারী, নবজাতক শিশু এবং প্রবীণদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা করবে সরকার বাহাদুর।

happy wheels 2