বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস: সর্বজনীন ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হোক

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস: সর্বজনীন ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হোক

সিংগাইর, মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান

দেশের প্রত্যেক নাগরিকই একজন ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে রয়েছে তার ‘ভোক্তা অধিকার’। এ অধিকার সংরক্ষণের প্রাথমিক ধাপ হলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। যদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরি না করা যায় তাহলে নানান ক্ষেত্রে বঞ্চিত ও প্রতারিত হন ভোক্তা অধিকার থেকে। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে সচেতনতা খুব বেশি দেখা যায় না। ক্রেতা এবং ভোক্তার মধ্যে একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ক্রেতা যখন নিজে ভোগের উদ্দেশ্যে কোনো পণ্য ক্রয় করেন তখন তিনি ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে আমাদের সকলেই সঠিক ও নিরাপদ পণ্য এবং সেবা পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্রীয় আইন কতৃক স্বীকৃত অধিকার।

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন নিজের কাছে মনে হয়েছে, নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জীবন কাটছে ভেজালের মধ্য আবদ্ধ থেকে। অধিক জনসংখ্যার খাদ্যের যোগানের দায়িত্ব যেন এদেশের কৃষক সমাজের উপরই পড়েছে। তাই তারা বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে গিয়ে অধিক উৎপাদনের আশায় জমিতে ব্যবহার করছেন অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। এদিক থেকে মাটির স্বাস্থ্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি এর প্রভাব পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবস্বাস্থের উপর। অন্যদিকে মাটির নিচে অণুজীব ও উপরিভাগের অসংখ্য কীট পতঙ্গগুলো ভোক্তা হিসেবে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার হারাচ্ছেন। আবার একজন কৃষক যখন ধান উৎপাদন করেন তখন তিনি উৎপাদক।

আবার একজন জেলে যখন সেই কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয় করেন তখন তিনি ভোক্তা। এখানে কৃষক হিসেবে ধান বিক্রি করে তার যেমন লাভজনক মূল্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে তেমনি ভোক্তা হিসেবে জেলে মানুষটার প্রকৃত মূল্যে ধান ক্রয় করার অধিকার রয়েছে। এখানে সমানাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন করে এক প্রকার অসাধু মুনাফাখোর ও মজুতদারি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি পায় রাতারাতি। আর এর বেশির ভাগ প্রভাব পড়ে দেশের বড় একটি অংশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর। কেননা প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ কৃষিসহ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ। তাদের আয়ে সাথে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে যায়। কেননা ভোক্তা অধিকার জীবন জীবিবকার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

ভোক্তা-অধিকার সুরক্ষা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ‘ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ প্রণীত হয়েছে। এ আইনের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ভোক্তা- অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ, ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত বিরোধ নিষ্পত্তি, নিরাপদ পণ্য ও সঠিক সেবা নিশ্চিতকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, পণ্য ও সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ এবং গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে ১৫ মার্চ দেশব্যাপি পালিত হয় বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস।

সম সাময়িক প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্য “ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নায্যতা”। মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় নিরাপদ, মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ও সেবা পাওয়া ভোক্তার অধিকার। ভোক্তা সে অধিকার থেকে এখনো বঞ্চিত। এরই মাঝে যুক্ত হয়েছে ইকমার্স প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি, ডিজিটাল আর্থিক খাতে প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিং এ প্রতারণা, অনলাইনে অবৈধভাবে ঋণদানের নামে প্রতারণা, ই-টিকেটিংয়ের ক্ষেত্রে মনগড়া সার্ভিস চার্জ আদায়। এবারের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ দিবসে এসব বিষয় বেশ গুরুপূর্ণ। সাধারণ ভোক্তা হিসেবে সঠিক মূল্যে পণ্যসমাগ্রী ক্রয় করা ও নিরাপদ পণ্য পাওয়ার অধিকার থাকলেও তা আজ ভুলুন্ঠিত। শহরে, হাটে, বাজারে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও দেখা যায় মাছ, মাংস, সবজি, ফলমূলে অধিক পরিমাণে ফরমালিন ও কার্বাইট ও কৃত্রিম রং ব্যবহার হচ্ছে। তাছাড়া থেমে নেই ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রিও। নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ দেয়া হচ্ছে মানব খাদ্যে। অবৈধ প্রক্রিয়ায় মানহীন পণ্য উৎপাদন ও বিপণন চলছে সমানতালে। ক্রেতা-ভোক্তাকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে মিথ্যা প্রলোভনের বিজ্ঞাপনে। ওজনে কারচুপি তো হচ্ছেই। বিক্রি হচ্ছে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য। যদি ভোক্তার ভোগ্যপণ্য নিরাপদ না হলে তা মানব শরীরের জন্য হুমকি হয়। ভোগ্য পণ্যটি সঠিক ওজনের হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ হবে না এবং বস্তুর গুণাগুণ পণ্যের বর্ণনার সাথে মিল থাকবে। কিন্তু আজকাল বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ থাকে। ওজনে কম দেওয়া, মানহীন পণ্য বিক্রি করা, ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করাসহ আরো অভিযোগ। অনেক সময় স্থানীয়ভাবে ক্রেতার সাথে তর্ক বিতর্কও হয়। তবে আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে অসচেতন। সেই অধিকারের বিষয়ে আমরা খুব কমই সচেতন। আমরা কেউ কেউ হয়তো এর প্রতিবাদ করি। আবার অনেকই কথা বলি না।

উল্লেখ্য, ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। জনগণকে অধিকতর সচেতন করার উদ্দেশ্যে এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৬২ সালের এই দিনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার এক বক্তব্যে ভোক্তার চারটি অধিকার সম্বন্ধে তিনি আলোকপাত করেন। এগুলো হলো-নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিযোগ প্রদানের অধিকার। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে আরও বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে। কেনেডির ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পালন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি সামাজিক সংগঠনগুলো নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনসচেতনতা তৈরিতে বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ব্রী-কালিয়কৈর নয়াপাড়া কৃষক কৃষাণি সংগঠন যৌথভাবে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করে। সংগঠনের সভাপতি মোঃ হযরত আলীর সভাপতিত্বে বারসিক কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের গুরুত্ব তুলে ধরে আলোচনা করেন। আরো আলোচনা করেন সংগঠনের সহ-সভপতি রমেলা বেগম, সাহাবুদ্দিন মিয়া, আব্দুল হালিম, হালিমা বেগম বিউটি আক্তার প্রমুখ। বক্তারা নিরাপদ পণ্য প্রাপ্তির জন্য সরকারি পদক্ষেপ জোরদার ও ভোক্তা অধিকার সর্বজনীনভাবে নিশ্চিত করার দাবি জানান।

happy wheels 2

Comments