শিখন স্কুলের শিক্ষায় আলোকিত ঘিওরের ১৮ হাজার বয়স্ক শিক্ষার্থী
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
‘আগে চোখে মুহে অন্ধকার দেখতাম, এখনে আলোর মুখ দেখতাছি। বাজান কইতো পড়ালেহা করণের দরকার নাই। পড়ালেহা বড় মানষেরগো জন্যে, আমাগো দেশে মাইয়া মানুষের পড়ালেখার দরকার নাইকা। নাম সই কিছুই লেখবার পারতাম না। টিপ দেওয়া লাগতো। এখনো পরবার পারি, লেখবার পারি।’ কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের বয়স্ক নারী শিক্ষার্থী পারুল বেগম (৪২)। তার মতো এই গ্রামে বহু নারী এখন বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক ব্যুরোর মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের নারী এবং পুরুষা পাচ্ছেন শিক্ষার আলো।
ব্যুরো অফ হিউম্যান ফ্রেন্ডশীপ (বিএইচ এফ) এর পরিচালনায় ৬ মাস মেয়াদী এই শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে ৩০০টি শিক্ষন কেন্দ্রের মাধ্যমে দিনে ৩০ জন নারী শিক্ষার্থীরা এবং রাতে ৩০ জন পুরুষ শিক্ষার্থীকে সাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন শিক্ষাদান করা হচ্ছে। মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৮ হাজার, নারী শিক্ষক সংখ্যা ৩০০ জন এবং পুরুষ শিক্ষক ৩০০ জন। প্রতি কেন্দ্রে নারী শিক্ষক একজন এবং পুরুষ শিক্ষক একজন কর্মরত আছেন। তবে শিক্ষা কার্যক্রম ঠিকমত চলেছে কিনা এই জন্য দেখভাল করার জন্য রয়েছে ১৫ জন সুপার ভাইজার। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। তবে মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় ঘিওরে বহু নারী পুরুষ শিক্ষার আলোতে আলোকিত হয়ে তাদের চোখেমুখে হাঁসির ঝিলিক দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিন কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা যায়, চট বিছিয়ে শিক্ষার্থীরা বসে আছেন। শিক্ষিকা জুঁই ও রানু তাদের চাট দেখিয়ে সুন্দরভাবে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিটি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো থেকে বই, ফ্লিপ, চাট, খাতা, কলম, ব্লাক, বের্ড, বসার চট, কেন্দ্রের সাইন বোর্ডসহ প্রযোজনীয় উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। নারীদের কেন্দ্রগুলো বিকেল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত এবং পুরুষদের সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চালু থাকে। রাতের কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুতের পাশাপাশি বিকল্প আলোর ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৬টি করে হারিকেন দেওয়া হয়েছে।
২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে ঘিওর উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ৩০০টি শিক্ষন কেন্দ্রে একযোগে উদ্ধোধন করা হয়। কেন্দ্রগুলো উদ্ভোধন করেন জেলা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো পরিচালক নিখিল চন্দ্র কর্মকার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার লিয়াকত হোসেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা খন্দকার ও ব্যুরো অফ হিউম্যান ফ্রেন্ডশীপ (বি এইচ এফ) পরিচালক আলহাজ¦ আব্দুল কাদের টিপু প্রমুখ। ১৫ থেকে ৪৫ বছরের প্রায় ১৮ হাজার বয়সের নিরক্ষর নারী এবং পুরুষকে সনাক্ত করে বিএইচ এফ বেসরকারী সংস্থাটি মৌলিক স্বাক্ষরতা কার্যক্রমটি নিবির ভাবে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক বর্তমানে এই প্রকল্পটি এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে শিক্ষা কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা নিবিড়ভাবে দেখাশুনা করা হয়। উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ, উপজেলা চেয়ারম্যান মাঝেমধ্যে শিক্ষন কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেন। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মতবিনিময় করেন এবং তাদের স্বল্প সময়ের শিক্ষা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
তেরশ্রী গ্রামের রুনু দাশ, দিপালী দাশ সাথী দাশ, রুবি বেগম, বিথী রানী, শিলা হালদার, সূচনা দাশ, দিপালী দাশ টগর দাশ, চায়না রানীসহ অসংখ্য নারী শিক্ষার্থীরা জানান, বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। সরকারর এই মহৎ উদ্যোগ নেবার ফলে তারা শিক্ষন কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে নিজেদের নাম ঠিকানা লেখাসহ ছোটখাটো হিসাব নিকাশ করতে পারছেন। মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের কর্মরত শিক্ষক জুঁই সাহা ও রানু আক্তার জানান, বর্তমান সরকার এই প্রকল্পের আওতায় এলাকার অনেক নিরক্ষর মানুষের উপকার হচ্ছে। আজকে অনেকেই নাম ঠিকানাসহ ছোটখাটো বিষয়গুলো লিখতে পড়তে পারছে।
ব্যুরো অফ হিউম্যান ফ্রেন্ডশীপ (বিএইচ এফ) এর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার চেয়ারম্যান আলহাজ¦ সৈয়দ মোঃ আব্দুল কাদের টিপু বলেন, ‘সরকারের নিয়মনীতি অনুসরণ করে যথাসময়ে সঠিকভাবে আমাদের কার্যক্রমটি চালিয়ে যাচ্ছি। সকল শিক্ষক শিক্ষিকা এবং সুপারভাইজাররা গুরুত্ব সহকারে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।’ তবে প্রকল্পের মেয়াদ, সকল সুপারভাইজার ও শিক্ষকদের বেতন ভাতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আইরিন পারভীন জানান, বর্তমান সরকারের মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্পটি একটি মহৎ উদ্যোগ। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে এলাকার লোকজনের অনেক উপকার হচ্ছে।