জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রক্রিয়া: একটি পর্যালোচনা
সিলভানুস লামিন
জলবায়ু এবং জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের সবচে’ আলোচিত বিষয়। বলা হয় গ্রীনহাউস গ্যাস মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত সংঘটিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে জানার আগে আমাদের অবশ্য জলবায়ু, গ্রীনহাউস গ্যাস কি এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিক কি কি উদ্যোগ রয়েছে সে বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা দরকার, যা এই লেখার মাধ্যমে কিছুটা হলেও সে সম্পর্কে অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের ধারণা দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করি। আমরা কমবেশি জানি যে, জলবায়ু বলতে সাধারণত ‘আবহাওয়ার গড়’কে বুঝানো হয়ে থাকে। এটি সাধারণত কোন নিদির্ষ্ট এলাকার তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত সংঘটন (বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত), বায়ু, সূর্যালোকের দিন এবং অন্যান্য বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। জলবায়ু আসলে একটি অত্যন্ত উচ্চমতাসম্পন্ন জটিল প্রক্রিয়ার প্রকাশরূপ। এই প্রক্রিয়াটি পাঁচটি উপাদানের মিথস্ত্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত হয়। পাঁচটি উপাদানগুলো হলো-বায়ুমন্ডল, জলীয়মন্ডল, পৃথিবীর বরফ আচ্ছাদিত অংশ, ভূমির সন্মুখ ভাগ এবং প্রাণীমন্ডল , অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন বলতে জলবায়ুতে পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। এই পরিবর্তনটি সময়ের পরিক্রমায় প্রকৃতিতে অনবস্থতা কিংবা মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণে সংঘটিত হয়। বায়ুমন্ডল ও সামুদ্রিক বিভিন্ন উপাদানের মিথস্ত্রিয়ার কারণেও জলবায়ু পরিবর্তন হতে পারে। ইউএনএফসিসিসি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত বিভিন্ন কর্মকান্ডকে দায়ি করেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নতুন কোন বিষয় নয়। বস্থত বিশ্বে মানুষ জাতির ইতিহাসের গতিপথ এবং বিকাশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই মানুষ এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে বা অভিযোজন করতে সমর্থ হয়েছে। বলা হয়, অতীতে জলবায়ু মানুষকে পরিবর্তন করতো তবে বর্তমানে মানুষেরা এই জলবায়ুকে পরিবর্তন করছে অতি দ্রুত গতিতে। বর্তমানে আমরা যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা করছি সেটি আসলে মানুষের কর্মকান্ড বিশেষ করে কার্বনভিত্তিক জ্বালানি তথা কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর মানুষের মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দিয়েছে। এই জ্বালানিগুলো গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তনে গ্রীনহাউস গ্যাসের ভূমিকা
গ্রীনহাউস গ্যাস হচ্ছে রাসায়নিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগ। এই রাসায়নিক উপাদানগুলো হচ্ছে-বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড, যা বায়ুমন্ডলে সঞ্চিত থাকে। তবে কার্বন ডাই অক্সাইড হচ্ছে গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রধান উপাদান এবং এটি সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে নির্গত হয়। সম্মিলিত এ গ্রীন হাউস গ্যাসগুলো অদৃশ্য সুর্যরশ্মির বিকিরণ (তাপ) শোষণ করে। শোষিত এই তাপ আবার বায়ুমন্ডলে প্রতিফলিত হয় এবং গ্রীনহাউস গ্যাস এই তাপ ধরে রাখে। এই প্রক্রিয়াটি পৃথিবীকে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে; তা না হলে পৃথিবী অতি শীতল হতো। এই প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডল গ্রীনহাউস গ্যাসের ‘দেয়াল’ হিসেবে কাজ করে যা সুর্যরশ্মিকে পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দিলেও তাপটি ভেতরে ধরে রাখে। প্রাকৃতিকভাবে সম্পাদিত এই প্রক্রিয়াকে গ্রীনহাউস গ্যাস প্রতিক্রিয়া বলে। তবে বায়ুমন্ডলে মানুষ অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রীন হাউস গ্যাস বেশি নিঃসরণ করায় গ্রীনহাউস প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী হয়ে বিশ্ব উষ্ণতা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, বন উজাড়, রাসায়নিক কৃষির প্রবর্তন, ভোগবিলাসিতার জন্য শক্তি তথা বিদুৎ, গ্যাস, তেলের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস বেশি নিঃসৃত হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা হয়েছে যে, ২০১০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত পৃথিবীর উপরিভাগে ৩৮৮ পিপিএম কার্বন ডাই অক্সাইড রয়েছে, যা এর সহনীয় মাত্রার চাইতে অনেক বেশি। অন্যদিকে কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মিথেন গ্যাসের ভূমিকা অনেক বেশি। এছাড়া মিথেন ওজোন স্তরের ক্ষতিতে ভূমিকা রাখে। বিশ্ব উষ্ণতা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান দিক। আনুমানিক ১৫০ বছর আগে থেকেই বৃহৎ পরিসরে শিল্পায়নের ফলে প্রয়োজনীয় গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা ২৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক প্রকাশিত একটি পুস্তিকার উদ্বৃত্তি থেকে জানা যায় ‘জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২৫% কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে বৈশ্বিক উদ্যোগ
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে কাজ করার জন্য বিশ্বে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে বিশেষ করে ইউএনইপি ‘ইউএনএফসিসিসি’ এবং ১৯৮৮ সালে আইপিসিসি একটি আন্তঃসরকার এডহক কমিটি। আইপিসিসির দায়িত্ব হলো জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মূল্যায়ন ও তথ্য প্রদান। এ প্রতিষ্ঠানটি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিসমূহ মূল্যায়ন করে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোকে বিজ্ঞানভিত্তিক, কারিগরি-প্রযুক্তি এবং আর্থ-সামাজিক তথ্য প্রদান করে এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি কাঠামো উন্নয়ন করে। অন্যদিকে হচ্ছে ইউএনএফসিসিসি একটি বহুজাতিক এমইএ, যা ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওডি জানিওরিতে জাতিসংঘের পরিবেশগত ও উন্নয়ণ বিষয়ক সম্মেলন(ইউএনসিইডি) বা আর্থ সম্মেলনে গঠিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে কার্যকর এই প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তঃদেশের সরকারগুলোকে একটি সার্বজনীন ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে দিয়েছে। সারাবিশ্বে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অনুধাবন করে ইউএনএফসিসিসি কিয়োটো প্রটোকল প্রণয়নে ভূমিকা রাখে। কিয়োটো প্রটোকল শিল্পোন্নত দেশগুলোকে (সংযুক্ত-১) দূষণ কমনোর জন্য একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় এবং এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য দেশগুলো কীভাবে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করবে তা এটি একটি সহজ ও নমনীয় দিকনির্দেশনা দেয়। যেমন: উন্নত দেশগুলো নিঃসরণ বাণিজ্য, যৌথ বাস্তবায়ন এবং ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম এর মাধ্যমে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমাতে পারে। নিঃসরণ বাণিজ্যের মাধ্যমে তারা অন্যদেশ থেকে কার্বন ক্রেডিট ক্রয় করে তাদের নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে আবার যৌথ বাস্তবায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে তারা ভিন্ন দেশে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে এমন প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে পারে যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর যে পরিমাণ কার্বণ নিঃসরণ হ্রাস হবে সেই পরিমাণ কার্বন ক্রেডিট তাদের নামে যুক্ত হবে। অন্যদিকে সিডিএম-র মাধ্যমেও উন্নত দেশগুলো গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে। যেমন: ধরুন ব্রাজিলের একটি কোম্পানি কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের পরিবর্তে বায়োমাস উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এক্ষেত্রে সিডিএম বোর্ড প্রত্যয়ন করে যে, ব্যবসা স্থানান্তরের মাধ্যমে কোম্পানিটি এক লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করেছে এবং কোম্পানিটিকে এক লাখ সিইআরস দেওয়া হয়। অন্যদিকে কিয়োটো প্রটোকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুক্তরাজ্য (সংযুক্ত-১ দেশ) বছরে এক মিলিয়ন টন গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যুক্তরাজ্য যদি ব্রাজিলের ওই কোম্পানির কাছ থেকে এক লাখ সিইআরস ক্রয় করে তাহলে বছরে যুক্তরাজ্যের গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা কমে গিয়ে ৯ লাখ টনে দাঁড়াবে।
এভাবে বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলো তাদের গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা হ্রাস করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিয়োটো প্রটোকলকে সমর্থন জানায়নি এবং ২০১২ পর কিয়োটোলের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর বিশ্বে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে তা এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না।