“ক্যাইত”: উপকূলীয় এলাকার ফসল সুরক্ষায় একটি অভিযোজন কৌশল
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের ভৌগলিক ও কৃষিপ্রতিবেশগত ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিাঞ্চল লবণাক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন এই লবণাক্ততাকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। মূলত এ লবণাক্ততা ও পরিবর্তিত জলবায়ুকে মোকাবেলা করে উপকুলীয় অঞ্চলের কৃষকদের কৃষি ফসল উৎপাদন করতে হয়। উপকূলীয় জনপদের সর্বশেষ উপজেলা সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর। একসময় এ জনপদের কৃষকেরা বোরো মৌসুমে কৃষি ফসল চাষাবাদ করে তা গবাদিপশুর হাত রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি যেমন সেজি গাছ লাগানো, বাঁশ, জিবলী কচা, খৈ ও বাবলা গাছের ডালপালা দিয়ে ঘেরা/বেড়া এমনকি নেট/ফাঁস জাল দিয়েও বেড়া তৈরি করতো। কিন্তু ১৯৮০ সালে কৃষিজমিতে লবণ পানি তুলে চিংড়ী চাষ এবং সিডর, আইলা ও ধারাবাহিক বন্যায় এলাকায় লবণ পানির প্লাবণ/জলোচ্ছাসে স্থানীয় এলাকার অধিকাংশ গ্রামের বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে বোরো মৌসুমে ফসল রক্ষায় প্রয়োজনীয় উপকরণের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়।
বিদ্যমান সংকট ও লবণাক্ত জলবায়ুকে মোকাবেলায় তাই এ জনপদের কৃষকেরা ফসল রক্ষায় নিজেদের উদ্ভাবনীশক্তি দিয়ে ক্যাইত (মাটির তৈরী বেড়া/ঘেরা) পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ধানখালী গ্রামের ধীরেন্দ্র মৃধার ছেলে মৃনাল মৃধা একজন প্রান্তিক কৃষক। তিনি ২০০২ সাল থেকে বোরো মৌসুমে মাটির তৈরি ক্যাইত দিয়ে ফসল রক্ষা করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বোরো মৌসুমে ফসল (ধান, গম, সবজি, তরমুজ, ডাল) চাষের পর ফসল রক্ষায় জমির চারিধারে এক চাপ করে মাটি কেটে দেওয়াল তৈরি করি। এতে করে ফসল ক্ষেতে গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস মুরগি ও বন্যপ্রাণী ফসলের ক্ষেতে ঢুকে ফসলের ক্ষতি করতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, “সাধারণত ৩/৪ ফুট উঁচু ও ১/দেড় ফুট চওড়া করে মাটি দিয়ে ক্যাইত তৈরি করা হয়। একে স্থানীয় ভাষায় ক্যাইতে বেড়া বলে। আইলার পর আমাদের এলাকায় অধিকাংশ গাছ পালা মারা যাওয়ার কারনে কৃষকেরা এই মাটি তৈরী বেড়া করে গবাদিপশুর হাত থেকে ফসল রক্ষা করে।”
এই পদ্ধতি ব্যবহারের কারণে মানুষও ফসল চুরি করতে পারে না বলে মৃনাল মৃধা জানানা। তিনি জানান, বর্তমানে একটি জিবলীর কচার দাম ১০ টাকা, একটি গরানের দাম ২০ টাকা, একটি বাঁশের দাম ২৫০ টাকা, এক গজ নেটের দাম ৩০ টাকা। এ সব উপকরণ কিনে এক বিঘা জমিতে ফসল বেড়া/ঘেরা দিতে খরচ হয় প্রায় ২/৩ হাজার টাকা। কিন্তু মাটির তৈরি ক্যাইতে বেড়া করতে কোন খরচ হয় না। নিজেরাই পরিশ্রম করলে হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এ বছর আমি মাটির তৈরি ক্যাইতে বেড়া দিয়ে ঢেড়স, পুঁইশাক, বরবটি, ডাটাশাক, খিরাই, চৈতীমুগ, মিষ্টি কুমড়া, ফুঁটি ও বেগুনের চাষ করেছি। জৈব সার ব্যবহার এবং পুকুরের মিষ্টি পানির সেচ দিয়ে আমি ওই সব ফসল চাষ করেছি। পোকামাকড় আক্রমণ কম, ফসল ভালোই হয়েছে।” তিনি প্রতি সপ্তাহে দু’বার ক্ষেত থেকে ফসল তুলে বিক্রি করেন। এভাবে বর্ষমৌসুম পর্যন্ত মাটির তৈরি ক্যাইতে বেড়া দিয়ে সবজি রক্ষা করবেন বলে তিনি জানান।
ক্যাইতে বেড়া মাটি যেখানে পড়ে, সেখানে মাটির উর্বরতা অনেক বেশি হয় এবং সে জায়গায় ধান খুব ভালো হয়। কারণ ক্যাইতে বেড়ার মাটিতে প্রচুর আলো/বাতাস পাওয়ায় সে মাটি বেশি উর্বর হয়। তাই এ পদ্ধতি ব্যবহারে পরবর্তী ফসল উৎপাদনও লাভজনক হয় বলে মৃনাল মৃধা জানান। উপজেলার কাশিমাড়ী ইনিয়নের খুঁটিকাটা গ্রামের কৃষক নিশিকান্ত মন্ডল, জ্যোতিষ বৈদ্য, কৃষাণী ভবানী ও শুক্রু রানী মন্ডলও মৃনাল মৃধার কথাকে সমর্থন করে বলেন, “খুটিকাটা বিল অনেক বড়। বোরো মৌসুমে সবার গরু, ছাগল, ভেড়া বিলে ছেড়ে দেওয়া থাকে। তাই বিলের জমি আমরা বোরো ধান ও গম চাষ করে গবাদিপশুর হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য এই ক্যাইতে বেড়া তৈরি করি। বিনা খরচে, কম সময়ে সহজ এই পদ্ধতিতে নরম মাটির বড় বড় চাপের উপর চাপ সাজিয়ে মাটির কাঁচা দেওয়াল তৈরি করি। এটি আমাদের গ্রামে প্রায় ১০-১২ বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে।”
বিলের মধ্যে অন্য কিছু দিয়ে বেড়া/ঘেরা তৈরি করলে তা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ক্যাইতে বেড়া বেশি উপযোগী। এ পদ্ধতিতে বেড়া/ঘেরা দিলে, একদিকে যেমন গবাদিপশু ফসল ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে নষ্ট করতে পারে না, তেমনি অন্যদিকে বন্যার পানি ক্ষেতে প্রবেশ করতে পারে না। ইচ্ছামত সেচের পানি জমিতে আঁটকে রাখা যায়। আবার হালকা ঝড় হলেও ক্যাইতে বেড়ায় তা বাধাগ্রস্ত হয় বলে ফসল হেলে পড়ে কোন ক্ষতি হয় না বলে তাঁরা জানান। তাঁরা আর জানান, বেড়ার মাটি আলো বাতাস পেয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাই। বর্ষার পানিতে গলে ঐ মাটি যেখানে পড়ে, সেখানের মাটিতে আমন ধানের শেকড় বৃদ্ধি পায় মাটির গভীর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে বলে ফলনও বেড়ে যায়। এভাবে বেড়া তৈরি করে ফসল চাষে তাঁরা অনেক লাভবান হচ্ছেন। দিন দিন কাইতে বেড়া/ঘেরা ব্যবহার আমাদের এলাকায় আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মূলত, জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণ পানির আগ্রাসনে কৃষি ফসল রক্ষার প্রয়োজনীয় গাছপালার বিদ্যমান সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে উপকূলীয় জনপদের কৃষকেরা তাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বোরো মৌসুমের ফসল রক্ষায় মাটির তৈরি এই ক্যাইত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। এই পদ্ধতি কৃষির উৎপাদন ব্যয় সাশ্রয়ী। নিঃসন্দেহে, পদ্ধতিটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদের কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর জীবনযাত্রার টিকিয়ে রাখার একটি পরিবেশবান্ধব ও স্থানীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার স্থায়িত্বশীল অভিযোজন কৌশল।