কৃষকের পায়ের ধুলা জমি ও ফসলের বড় বন্ধু- কৃষক সবুর সানা
কয়রা, খুলনা থেকে ঘুরে এসে মফিজুর রহমান ও বাবলু জোয়ারদার
মুখভর্তি সাদা দাড়ি। অনেক লম্বা এবং গায়ের রং কালো। বয়স প্রায় ৭১ বছর (জন্ম ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে)। দেখলেই অনুমান করা যায় মানুষটির চেহারার সাথে মাটি-পানি-বন-নদী-জলাশয় ও কৃষির সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে মানুষটি সর্ম্পকে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছি, তিনি হলেন, বাংলাদেশের ১৩নং কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চল ও উপকূলীয় কয়রা জনপদের আমাদী ইউনিয়নের দশবাড়িয়া গ্রামের অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রবীণ কৃষক সবুর সানা।
ছোট বেলা থেকেই সবুর সানা কৃষি পেশাকে মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন। নিজের কৃষি জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণনাাকালে প্রবীণ কৃষক সবুর সানা বলেন,“শিশুকাল থেকেই বাপের সাথে বিলে গরু চরানো, নদী-খালে মাছ ধরা, জমি চাষ করা, ফসল লাগানো, কাটা, মাড়াই, সংরক্ষণ, বাজারে বিক্রিসহ কৃষির যাবতীয় কাজে হাতেখড়ি হয় আমার।” তিনি বলেন, “আগের দিনের জমির মাটি আর এখনকার মাটির মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক (পার্থক্য)। আগের দিনে আমরা বিলে পাল পাল (দল) গরু চরাতাম। বিলে প্রচুর গোবর পড়ে থাকত। বর্ষার পানিতে পচে সার হয়ে জমির মাটির সাথে মিশে যেত। জমিতে বিভিন্ন ঘাস ও নাড়া (ধান গাছের অংশ) পচে মাটি কালো হয়ে যেত। গরুর লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ দিয়ে ধান রোয়া দিলে ধান গাছ সুস্থ-সবল ও তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠত।” তিনি আরও বলেন, “ধান দেখলে মন ভরে যেত। ধান উৎপাদনে চাষ, লাগানো ও কাটা ছাড়া কোন খরচ হত না। মাটির প্রাকৃতিক শক্তি (উর্বরতা) ছিল অনেক বেশী। উঁচু জমি-মাঝারি ও ধাপা (নিচু) জমিতে এক এক ধরনের ধান জাত চাষ করতাম। আশফাইল, ডাকশাইল, চিনিকানি, পাটনাই, গেতি ও বড়ান ধান জাত চাষ করতাম। বাজার থেকে কোন দিন বীজ কিনতে হতো না। একে অন্যের মাঝে বিনিময় করতাম বীজ ও বিভিন্ন কৃষি উপকরণ। বর্তমানে সেই দিন আর নেই।”
সবুর সানা জানান, এখন জমির মাটি নষ্ট (উর্বরতা হ্রাস) হয়ে গেছে। বাজারের বিভিন্ন সার মেরে মেরে মাটির জোঁ সব শেষ। মাটি এখন শক্ত ও ঝিলের মত। কৃষক এখন বাজারনির্ভর হয়ে পড়েছে। বীজ, সার, কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের ক্যারেন্ট জালে (কোম্পানি/বাজার নির্ভর) আটকে ফেলেছে। ফসলের অনেক জাত এখন আর পাওয়া যায় না। এরপর কৃষি জমিতে নদীর লবণ পানি তুলে চিংড়ী চাষ শুরু হলে, কৃষি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, আগের দিনে, খালে-বিলে বিভিন্ন মাছ-শোল, বোল, মাগুর, কই, বাইন, বেলে, ট্যাংরা, জেল, পুঁটি, মৌরুল্য মাছ পাওয়া যেত। সেই খাল-বিল এখন নোনা পানির আধার আর ঐ সমস্ত মাছ এখন পাওয়া যায় না। কত রকম শাক, শালুক, ঢাব, ব্যাঙ, কুচে, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক পাওয়া যেত, যা ছিল কৃষির জন্য অনেক উপকারী, সেগুলোও হারিয়ে গেছে। আগের মত এলাকায় আর গরু/ছাগল/ভেড়া নেই। কি করে থাকবে? বিলে যে এখন চিংড়ি ঘের।
এসব অসুবিধা থাকার পরও তিনি এখনও কৃষি পেশায় যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, “আমি কৃষি পেশা নিয়ে পড়ে আছি। আমার মোট কৃষি জমি ৭ বিঘা ও বসতভিটা ২ বিঘা। আমি সারাজীবন জমির মাটিতে বসতভিটার জৈবসার ও আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করি। মানুষের স্বাস্থ্যের মতো মাটিরও স্বাস্থ্য ভালো না রাখলে ফসল ভালো হয় না।” তিনি আরও বলেন, “আমি বিলের জমিতে ধান চাষ এবং বসতভিটায় সবজি চাষ করি। সাধারণত বাজার থেকে তেমন কিছু কেনার প্রয়োজন পড়ে না।”
সবুর সানা প্রতিবছর কার্তিক মাসে বসতভিটার জমিতে লালশাক, সাদাশাক, বেগুন, আলু, ঔলকপি, টমেটো, পালং শাক জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ, ঔল, কচুরমুখি, পুঁইশাক, ঝিঙ্গে, শসা, ঢেষড়, কুমড়া, হলুদ, ঝাল, পেয়াজসহ সব ধরনের সবজি চাষাবাদ করেন। এখনো সারাবছর তাঁর পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, খুরকনো, গলদা, পুঁটি, মাগুর, চ্যাং, শোল, কই ও কাপ জাতীয় মাছ থাকে। বসতভিটার চারিধারে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ গাছ যেমন-আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, গবেদা, জামরুল, পেঁয়ারা, তাল, লেবু, সুপারি, নিম, সজিনা, জিবলী, পাকড়া, বাঁশ, খই, চটকা, পার্শেমাদার, নিশিন্দা ও বাবলা গাছ আছে। তিনি বিভিন্ন গবাদি পশুপাখিও পালন করেন। তাঁর রয়েছে ৪টি গরু, ১০টি ছাগল ও ২০টির মতো হাঁস ও মুরগি। এছাড়া তিনি স্থানীয় ডাকশাইল, চিনিকানি, আশফাইল, পাটনাই এবং ১০, ১১ ও ৩০ ধানসহ সকল প্রকার ফসলের বীজ বাড়িতে সংরক্ষণ করেন। সবকিছু মিলে পরিবারের ১৫ সদস্যের সারা বছরের মাছ, সবজি, চাল, ডিম, দুধ ও ফলের চাহিদা পূরণ হয়ে যায় বলে তিনি জানান।
সবুর সানার কাছ থেকে এখন অনেকে পরামর্শ নিতে আসে। কৃষিতে তাঁর সাফল্য এবং কৃষি চর্চায় তাঁর জৈব ব্যবস্থাপনা অন্য কৃষককে আকৃষ্ট করে তুলে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমার কাছে এলাকার অনেক কৃষক কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ নিয়ে যায়। আমার মতে, এ দেশের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হলে, কৃষির সকল উপকরণের উপর কৃষকের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। কৃষককে বাজার ও কোম্পানি নির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি কৃষির প্রাকৃতিক উৎস ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।”
কৃষক সবুর সানার মতে, বিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত খাল/জলাশয়কে লবণ পানির আওতামুক্ত রাখলে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ব্যবহার উপযোগী করা যাবে। কারণ, খাল/জলাশয়ে মিষ্টি পানি রাখতে পারলে, ২ মৌসুমে কৃষি জমিতে ধান চাষ করা সম্ভব হবে। আজাবা (বনজ) অনেক শাক, মাছ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানও এতে সংরক্ষিত হবে। এতে করে গ্রামের সকল কৃষি পরিবার অনেক বেশি লাভবানসহ কৃষি কাজে আগ্রহ বেড়ে যাবে।
অন্য কৃষকদের প্রতি তাঁর পরামর্শ হলো- কৃষিকে অনেকটা সন্তানের মতো দেখতে হবে। জমিতে ফসল চাষ করে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। প্রতিদিন ফসল ও জমির সাথে কৃষকের দর্শন হতে হবে। কারণ কৃষকের পায়ের ধুলা জমি ও ফসলের বড় বন্ধু।
প্রবীণ এই কৃষকের কৃষি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। তার বসতভিটার পিছনে সবজি ক্ষেত, একপাশে গোলাঘর, ঢেঁকিঘর, কাঠ ঘর, গোয়ালঘর, হাঁস-মুরগি ও ছাগলের ঘর, একটু দূরে মিষ্টি পানির পুকুর এবং বসতভিটার পাশে বিলের কৃষি জমি। পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের যাবতীয় উৎস সরবরাহ হয় তার ঐ সমস্ত সম্পদকে কেন্দ্র করে। সর্বোপরি প্রবীণ কৃষক সবুর সানার কৃষি জীবনের অভিজ্ঞতাকে শুধুমাত্র উপলদ্ধি ও অনুধাবন করলে চলবে না, পক্ষান্তরে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের বাংলাদেশের সমৃদ্ধ কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য কৃষকের জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, কৃষি ও কৃষকের প্রাণ বিসর্জন হবে এবং আমরা হবো পরনির্ভশীল।