পাবনার চাটমোহরে বক নিধন বন্ধে উদ্যোগ নিন
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও মিঠাপানির জলাশয় জলজ উদ্ভিদ পূর্ণ জলাশয় খাল বিল পুকুর ধানক্ষেতে মৎসভোজী জলচর পাখি বক-এর বসবাস। সবুজ ধানক্ষেতে বিভিন্ন রঙের বকের বিচরণ ও সুনীল আকাশের উড়ন্ত বক পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে যোগ করে বাড়তি মাত্রা। পৃথিবীতে ৬৪ প্রজাতির বকের বিচরণ থাকলেও আমাদের দেশে ক্রমশই বকের প্রজাতি ও সংখ্যা কমে আসছে। বকের বসবাসের স্থান ধ্বংস হওয়ায়, যথেষ্ট পরিমাণ বনজ এলাকা না থাকায় এবং জমিতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাবে কমছে বকের সংখ্যা।
সাদা, হলদে, হলদে বাদামীসহ বিভিন্ন রঙের বক সাধারণত লম্বায় ৩৪ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটারের মতো হয়। কোন কোন প্রজাতির বক আকারে এর চেয়ে বড়ও হয়। বক পাতা বা উদ্ভিদের নিচে লুকিয়ে থাকা ছোট মাছ, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়। কচুরিপানা পূর্ণ জলাশয়ে, নদীতটে ও যে স্থানগুলোতে স্বল্প পানি জমে থাকে ও মাছ থাকার সম্ভাবনা থাকে এমন জলাধারে ও বকের দেখা মেলে। বাঁশ ঝাঁড়সহ বন বাদারে বাসা বেঁধে বসবাস করে। স্ত্রী বক চার থেকে ছয়টি পর্যন্ত ডিম দেয়।
পাবনার চাটমোহরসহ চলনবিলাঞ্চলে বর্ষার শেষ ভাগে এসে বক শিকারীদের আনাগোনা বেশি চোখে পরে। নাটোরের জোনাইলের পাশে অবস্থিত গল্ল্যার বিলে বেশি বক ধরা হয় বলে জানান বক শিকারীরা। বক শিকার করে বিক্রি করেন তারা। গত ৩০ অক্টোবর মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে চাটমোহরের বিল থেকে বক শিকার করে পৌর সদরের প্রধান সড়ক হয়ে বাড়ি ফিরছিলেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাগডোব গ্রামের মনির আলীর ছেলে আমির আলী (৩৫)। চাটমোহর উপজেলা পরিষদের গেটের পশ্চিমে আলাপ হয় আমীর আলীর সাথে। বক দিয়ে বক ধরার গল্প শোনান তিনি।
আমীর আলী বলেন, ‘বক ধরার জন্য এক প্রকার ফাঁদ পাতি আমরা। বাঁশের ছোট বানা বৃত্তাকার করে মাটিতে পুঁতে দেই। এর উপরাংশ সবুজ করার জন্য কলা ও খেজুরের পাতা দিয়ে ঢেকে দেই। কলাপতার উপরে বেঁতের একটি বাতা এমন করে স্থাপন করি যেন এর উপরে কয়েকটি বক বসতে পারে। এভাবে ডোবা নালা জলাশায়ের পাড়ে ফাঁদ স্থাপন করে বৃত্তাকার ওই ফাঁদের ভিতর কলাপাতার নিচে লুকিয়ে থাকি।’ তিনি আরও বলেন, ‘কলাপাতার মধ্য খানে একটু কেটে দেই যেন উপরে বক বসলে নিচ থেকে হাত দিয়ে বক ধরে নামিয়ে আনা যায়। আমরা আমাদের পোশা বকগুলো ফাঁদের উপরাংশের বেতের বাতার সাথে বেঁধে রাখি। পোশা বকগুলো ডাকলে এর শব্দ শুনে অথবা পোশা বকগুলো দেখে বুনো বকেরা এসে বসে ঐ বেতের বাতায়। তখন আমরা নিচ থেকে অতি সন্তর্পণে কলাপাতার ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বুনো বকের পা চেপে ধরে নিচে নামিয়ে আনি। অনেক সময় বকের ঠোকর খেতে হয়। এভাবে প্রতিবছর ভাদ্র থেকে ফাল্গুন এ সাত মাস বক ধরি।’
তিনি বলেন, ‘বর্ষার সময় কয়েক মাস মাঠে খুব একটা কাজ থাকে না। কোন জমা জমি নেই। মামা সম্পর্কীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে ঘড় করে সেখানেই বসবাস করছি। বক নিধন অন্যায় জানি কিন্তু বিপদে পরে বক ধরি। কেউ নিষেধও করে না কোনদিন। চলা তো লাগবি। এক ছেলে এক মেয়ে স্ত্রী ও আমি এ চার জনের সংসার চালাতে হয় আমাকে। কখনো কৃষি কাজ করি। কখনো গাছ ঝোড়ার (পরিষ্কার করার) কাজ করি। যখন এসব কাজ পাই না তখন পেটের দুঃখে বিল খাল ডোবা নালা জলাশয়ে বক ধরি। প্রতি জোড়া বক ২শ’ থেকে ২শ’ ৫০ টাকায় বিক্রি করি। কোন দিন চার-পাঁচটা আবার কোনো দিন এর চেয়ে বেশি বক ও পাওয়া যায়।’
চাটমোহর সরকারি ডিগ্রী (অনার্স) কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ের প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান পরিবেশবিদ ড. মুক্তি মাহমুদ জানান, বক ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ খেয়ে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। বক শিকার করা দন্ডনীয় অপরাধ হলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অনেক শিকারী জলাশয় থেকে বক শিকার করে বিক্রি করে থাকেন যা কাম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনৈতিক হওয়া সত্বেও অনেক সৌখিন শিকারি শখ মেটাতে বক শিকার করেন। ভোজন রসিকরা বকের মাংস খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন কিন্তু এটা ভেবে দেখেন না এটি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বক ভূমিকা রাখে। বড় বড় গাছের সংখ্যা কমে আসায় এবং শিকারীদের অপতৎপরতায় আমাদের দেশে বকের সংখ্যা কমে আসছে। যেহেতু বক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সেহেতু বক নিধন রোধ কল্পে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত।’