সাতক্ষীরার শোল মাছ রক্ষায় ব্যতিক্রম উদ্যোগ
সাতক্ষীরা থেকে তানজির আহমেদ ও শাহীন ইসলাম
মাছে ভাতে বাঙালি। আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য। দেশের অঞ্চলভেদে শোল, কই, মাগুর, টাকি, শিং, জিয়েল, মলা, ডেলা, বেতলা, পুঁটি, বাইন, বেলে প্রভৃতি মাছের নামগুলো আমাদের স্বাদ ও সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে, যা আজ অনেকাংশে বিলুপ্ত ও বিপন্ন। মাছের সেই জায়গা বহুলাংশে দখল করে নিয়েছে ভিনদেশী থাই কৈ, আফ্রিকান মাগুর, মনোসেক্স তেলাপিয়া, থাই পাঙ্গাশ এমনকি মানুষ খেকো পিরান হা। বাঙালির ভাত বলতে সুগন্ধি, পুষ্টিকর, মুখরুচোক চিনিকানি, বালাম, বাশমতি, দারশাইল, কালজিরাসহ হাজারও দেশী ধান জাতের ভাতের অবস্থাও অনেকটা মাছের মত। ৩০, ৪০, চিকন, মিনিকেট, সরু, হিরা, রতœা, জিং সমৃদ্ধ ও রাতকানা রোগ নিরাময়ে গোল্ডেন রাইসসহ নানান রঙ ও নামের চাউলের ভাত। আমরা খাদ্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যকে ভুলে বাণিজ্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছি। ফলে মাছের ও ধানের জাতের বৈচিত্র্য বিলুপ্ত ও বিপন্নর মত অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে আমাদের আদি পরিচয়ও। আগ্রাসি ও একক প্রজাতির বাণিজ্যিক মাছের চাষ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার, স্থানীয় মাছের প্রতিবেশ খাল, জলাশয়, ডোবা, নালা, পুকুর, নদী ভরাট, দখল, জোরপূর্বক লবণ পানি উত্তোলন এবং সর্বোপরি সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগ ও প্রচেষ্টার অভাবসহ অজানা অনেক কারণে দিন দিন আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী মাছগুলো আজ বিপন্ন ও বিলুপ্ত। তবে, এতসব প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বাঙালির ঐতিহ্যের স্থানীয় প্রজাতির শোল মাছ সংরক্ষণ, চাষাবাদ এবং সম্প্রাসারণের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাতক্ষীরার জাকির হোসেন।
জাকির হেসানে মাত্র পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি পুকুরে দেশি জাতের শোল মাছের চাষ করেছেন। কম খরচে অল্প দিনেই প্রায় পাঁচ মণ মাছ পেয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স জাকির হোসেন ভাসমান অবস্থায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এক জোড়া শোল মাছ। সযতেœ মাছ দু’টিকে ছেড়ে দেন নিজের পুকুরে। প্রতিনিয়ত মাছ দু’টিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি জানান, গত বছরের ১০ আগস্ট ডিম ছাড়ে মা মাছটি। তারপর পোনা বের হয়। এই পোনাই তার পুকুরে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এক একটি শোল মাছের ওজন হয়েছে সর্বনি¤œ আটশ’ গ্রাম। তিনি আশা করছেন একবছরের বয়স হলে এই মাছের ওজন এককেজিরও বেশি হবে। জাকির জানান, পুকুরে কোনো সার দেননি তিনি। চুন কিংবা কোনো রাসায়নিক খাবারও নয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে মাছগুলো বেড়ে উঠেছে। বাজারের ছোট মাছই এই শোল মাছের প্রধান খাদ্য। জাকির রোজ সকাল বিকাল খাবার দেন তাদের। জাকির বলেন, “রাক্ষুসে মাছ হিসাবে সবাই এড়িয়ে চলেন শোল মাছকে। কারণ তারা মনে করেন শোল মাছ সব ছোট মাছ খেয়ে ফেলে।” তিনি শোল মাছের সাথে চিতল, রুই, কাতলার চাষও করেছেন। তাদের বৃদ্ধিও নজর কাড়ার মতো। তিনি বলেন, “মানুষ যাকে পুকুরের অন্যান্য মাছের জন্য শত্রু মনে করেন আমি তাকে বন্ধু হিসেবে আপন করে নিয়েছি।”
জাকির তার বাড়িতে গড়ে তুলেছেন গুড়পুকরের রিসার্চ ইনস্টিটিউিট। পুকুরে শোল মাছের চাষ এই গবেষণা ইনস্টিটিউিট-এর অধীনে হচ্ছে বলে তিনি জানান। পুরনো জোড়া শোলের ওজন এখন দুই কেজি ছাড়িয়ে গেছে জানিয়ে বলেন, “পাশেই নতুন আরও একটি পুকুর খনন করেছি। সেখানে এই পুরুষ ও মা মাছটিকে ছেড়ে দেব। সেখানে আবারও শুরু হবে নতুন পত্তন।” জাকিরের পুকুরের পানি ছয় ফুটের কম নয়। চকচকে পানি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সবই প্রাকৃতিক। পানিতে হাঁস নামা নিষেধ, কিন্তু মানুষের গোসল বারণ নয়। তিনি পুকুরে দেশি শোল চাষ করে লাভবান হয়েছেন। তার মতে, সবাই এগিয়ে এলে বাংলাদেশের দেশি জাতের মাছই হতে পারে বিশ্ব সেরা মাছ’। তার দেখাদেখি অনেকে আগ্রহী ও মনোযোগী হচ্ছেন। দেশি জাতের মাছ যাতে হারিয়ে না যায় সেই উদ্যোগই নিতে হবে বলে জানান তিনি। দেশি জাতের মাছ যেখানে হারিয়ে যেতে বসেছে সেখানে শহরের পুরাতন সাতক্ষীরার জাকির হোসেন শোল মাছ চাষ করে সবার নজর কেড়ে নিয়েছেন। দেশী প্রজাতির প্রতিটি মাছ রক্ষায় জাকির হোসেনের মত অসংখ্য উদ্যোক্তা তৈরি হোক সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। (তথ্য ও ছবি সহযোগিতায়: জাকির হোসেন এবং সাংবাদিক সুভাস চৌধুরি)।