মনের জোরই সবচে’ বড় সাহস-আবু সায়েম
‘ধনী-গরিব সর্বহারা করবো মোড়া লেখাপড়া’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের নয়াবাড়ি আদর্শগ্রামে ৫জন যুবক-যুবতী মিলে গড়ে তুলেছেন একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র। নাম দিয়েছেন ‘পল্লী মঙ্গল আদর্শ পাঠশালা’। এই পাঠাশালা গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগীদের কোন আর্থিক বা অবকাঠামোগত সক্ষমতা ছিলো না তবে ছিলো মনের জোর। মনের জোরকে সবচে’ বড় সাহসে পরিণত করে তারা যে পাঠশালা গড়ে তুলেছেন সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নয়াবাড়ি আদর্শগ্রাম, নয়াবাড়ি, গাড়াদিয়া ও বায়রাসহ এলাকার প্রান্তিক পরিবারের ছেলে মেয়েরা। আর্থিক দৈন্যতার কারণে অকালে ঝড়ে পড়া শিশুরা এলাকার আবু সায়েম, মারুফা আক্তার, রুবিনা বেগম, সাইফুল ইসলাম, আলমগীর হোসেনের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘পল্লী মঙ্গল আদর্শ পাঠশালায় পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। যুবকদের এই উদ্যোগে অভিভূত হয়ে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ বাড়িয়েছেন সহযোগিতার হাত। বর্তমানে ৯৯ জন শিশুর কলকালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে শিশু শিক্ষা কেন্দ্রটি। যুবক-যুবতীদের স্বপ্ন ছিলো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। এই স্বপ্নযাত্রার সাথী এবং মূল উদ্যোগক্তা আবু সায়েমের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তাদের স্বপ্নের কথা বিস্তারিতভাবে বারসিকনিউজ. কমকে জানান। তিনি তুলে ধরেছেন তাদের স্বপ্নযাত্রার উদ্দেশ্য, ইতিহাস ও গুরুত্ব! আবু সায়েম এর সাথে আলাপপচারিতার বিশেষ অংশগুলো বারসিকনিউজ.কম এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরছেন মানিকগঞ্জের বিউটি রানী সরকার ও শিমুল কুমার বিশ্বাস।
বারসিকনিউজ: শিশুদের নিয়ে এই ধরনের স্কুল তৈরি করার চিন্তা কিভাবে এল এবং কেন আসলো ?
আবু সায়েম: হইছে কি আমি তো বেতিলা স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। দীর্ঘদিন সময়ও দিয়েছি। সেখান থেকে হঠাৎ করে নিজেই এই ছিন্নমুল শিশুদের নিয়ে স্কুলটা গড়ে তুললাম। এদিকে আমার বেশ কিছু টিউশনি ছিল। সেই সুবাদে দেখলাম এইখানকার শিশুরা তিনটি কারণে পড়া লেখা করার সুযোগ পাচ্ছে না। একটা কারণ হলো ভৌগলিক দিক থেকে স্কুল অনেক দুরে। দ্বিতীয়ত: অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। তৃতীয়ত: আশেপাশের যে স্কুলগুলো আছে, সে স্কুলগুলোর বেতন বেশি হওয়ার কারণে অনেকেই স্কুলে যায় না। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে যে, ৫ জনের ৩ জনই লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। আমি চাইলাম যে, এই তিনটা সমস্যার সমাধান করে যদি এদেরকে লেখাপড়ার আওতায় আনা যায় তাহলে বোধহয় অনেক ভালো হবে ।
বারসিকনিউজ: এই কাজ করার জন্য কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন ?
আবু সায়েম: প্রথমত আমি যে স্কুলটা করতে চাই, ছিন্নমুলদের নিয়ে যে কাজ করতে চাই, ঝড়ে পড়াদের নিয়ে কাজ করতে চাই এবং ওদের সমস্যা যে আমি নিজেরও সমস্যা মনে করি, ওদের কষ্টটা যে আমি নিজেও শেয়ার করতে চাই, সেই বিষয়গুলো এই এলাকায় আমার শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করি। এরপর আমি আমার শিক্ষার্থীদের নিয়ে এলাকার অভিভাবকদের কাছে আমার উদ্দেশ্যটা জানাই। অভিভাবকরাও আমার কথায় সাড়া দেয়। এরপর আমি কাজটি শুরু করি।
বারসিকনিউজ: আপনি এই কাজ নিজে নিজেই করেছেন, নাকি অন্য কারোর সহযোগিতা নিয়েছেন?
আবু সায়েম: আসলে আমি একা এই কাজ করতে পারি নাই। আশপাশের লোকদের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে মো. ইমান (নয়াবাড়ি কৃষক সংগঠনের সদস্য)। তিনি জমি দিয়ে সহায়তা করেছেন। তাছাড়া আমার ছাত্রীর মা (সাদিয়া) আমাকে একবছর আগে স্কুল চালানোর জন্য ঘর দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। এছাড়া এলাকার আরো অনেকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। যেমন: ব্যবসায়ী সালাম গাছ দিয়েছেন, ব্যবসায়ী রাজীব ঘরের খুঁটি দিয়েছেন, নয়াবাড়ি আদর্শগ্রাম সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. রফিক বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়েছেন, গ্রামের দর্জি মো. শফিক টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া হাবিবুর মাস্টার টাকা দিয়েছেন। তাদের সহযোগিতার মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে নতুন স্কুলঘরটি।
বারসিকনিউজ: আপনার স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সংখ্যা কত?
আবু সায়েম: এক বছর আগে আমি ৬৫ জন শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলটা শুরু করেছিলাম। বর্তমানে ৯৯ জন শিক্ষার্থী এ স্কুলে পড়াশোনা করছে। আর আমি প্রথম যখন স্কুল শুরু করেছিলাম তখন আমি একাই পড়াতাম। পরে যখন শিক্ষার্থীরা সংখ্যা বাড়লো তখন আমি আরো চারজনকে সাথে নিয়েছি। আমার সাথে আরো চারজন যারা আছে তারা এই এলাকার শিক্ষার্থী। আমি ওদেরকে একসময় প্রাইভেট পড়াতাম। তারা হলেন মারুফা আক্তার, রুবিনা বেগম, সাইফুল হাসলাম এবং আলমগীর হোসেন।
বারসিকনিউজ: আপনার চার জন সহযোগী কিভাবে আপনার সাথে জড়িত হলো?
আবু সায়েম: এরা আমার ¯েœহভাজন। আমাকে আগে থেকেই তারা জানে, চিনে। আমার আদর্শে অনুপ্রাণিত। আমি যখন কাজটা শুরু করি তখন তারা বলেছিল যে, এই কাজ থেকে যেন তাদেরকে বঞ্চিত না করি। ওরা আমাকে বলেছিল তাদেরকে যেন এখানে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ দিই। তাদের বাড়ি কিন্তু এখানেই; স্কুলের আশপাশেই। আপনি জানেন কিনা, আমরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে ডেকে এনে পড়াই। এমনভাবে শিক্ষক নিয়েছি যাতে তারা তাদের আশেপাশের শিক্ষার্থীদের সাথে করে নিয়ে আসতে পারে।
বারসিকনিউজ: আপনার এখানে এই যে, এত শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের খরচ কিভাবে চলে?
আবু সায়েম: আমি তো আগেই বলেছি আমার ভরসা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। যারা আমাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। তাদের সহায়তার টাকা দিয়ে আমি এই স্কুলঘর এবং বাচ্চাদের বই দিয়েছি। তাছাড়া আমাদের বায়রা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ইউএনও অফিসের মাধ্যমে আগামী বছরে বই সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। তাছাড়া এই স্কুলের যে শিক্ষক আছে তাদের তেমন কোন চাহিদা নেই। তাদের সামান্য কিছু সন্মানি দেওয়া হয়। আমার সহযাত্রীরা শিক্ষা দিতে পারাটাই প্রথম সন্তুষ্টি বলে মনে করেন।
বারসিকনিউজ: শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কি কোন ধরনের বেতন নেন?
আবু সায়েম: বেতন কিছু নেওয়া হয়। তয় সেইডার ধরা বাধা নিয়ম নাই। যে যা পারে তা দেয়। আমিও সেটা নেয়। সত্যি বলতে কি আমি যখন এলাকার ছেলেমেয়েদের মা বাবার কাছে এই স্কুল বানানোর কথা বললাম, তখন সবাই আমারে বললেন ‘মাষ্টার সবই ঠিক আছে তয় বেতনটেতনের কথা তো কইলা না।’ আমি বললাম কি আর বলবো তাদের পাঠান তো! তখন তারা বললেন, ‘বুচ্ছি মাষ্টার তুমি এমনিতেই পড়াইতে চাইতাছো। তয় আমরা তোমার জন্য যে যা পারি তা তোমারে দিব।’
বারসিকনিউজ: এখনো কি আপনার সেই নিয়ম বলবৎ আছে ?
আবু সায়েম: এখনো সেই নিয়মই আছে। ঐ যে যা পারে তাই দেয়। কেই ৫০ টাকা দেয় আবার কেউ ৬০ টাকা দেয়, আবার কেউ ৮০ টাকা। অনেকে আছে কিছুই দেয় না।
বারসিকনিউজ: এই যে বললেন অনেকের আছে যারা কোন বেতন দিতে পারে না তাদের সংখ্যা কতজন হতে পারে?
আবু সায়েম: তা, ধরেন বেতন দিতে পারে না, তার পরিমাণ ২৫% এর মতো হবে। তবে আমি অভিভাবকদের বলেছি, যদি কোনসময় স্কুলের বেতন দিতে নাও পারেন তাহলেও বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন। স্কুলে পাঠানো বন্ধ করবেন না কিন্তু।
বারসিকনিউজ: স্কুল পরিচালনার ভবিষ্যৎ কৌশল কি?
আবু সায়েম: কৌশল আর কি, মনের সাহসই বড় কথা। আমি মনের জোরেই এই পাঠশালা গড়ে তুলেছি এবং আমি বিশ্বাস করি এই স্কুল চালানোর জন্য যারা সহযোগিতা করেছেন এবং আশ্বস্ত করছেন পরবর্তীতেও তাঁরাই সহযোগিতা করবেন। তাদের কাছে আমার এক ধরনের দাবি তৈরি হয়েছে। এলাকার যে গণমান্য ব্যক্তি আছেন যারা সহযোগিতা করেন, তাদেরকে বলবো যে, দিনে চার পাচটা চা খান সেখান থেকে বাঁচিয়ে আমাকে দিবেন। তাছাড়া এলাকায় যারা ধনী ব্যক্তি রয়েছেন তাদের কাছেও আবেদন করবো। আমি বিশ্বাস করি কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই।
বারসিকনিউজ: এই স্কুল থেকে আপনার প্রত্যাশা কি?
আবু সায়েম: মানুষ তো কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চায়। আমি কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চাই। এই স্কুল করার মাধ্যমে আমি চাই ছিন্নমূল ও ঝরে পড়া শিশুরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হোক, পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখুক এবং নিত্যনতুন ভালো কাজ করুক।,