সুই-সূতায় স্বপ্ন আঁকে মানিকগঞ্জের ৪০ হাজার নকশী শিল্পী
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
ঈদ সামনে রেখে পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর শাড়িতে নকশা ভরাটের (হাতে সেলাই) কাজ নিয়ে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন মানিকগঞ্জ জেলার প্রায় ৪০ হাজার নকশী শিল্পী। তাদের হাতের নিপুণ কাজে প্রায় ৫ লাখ পিস বর্ণিল পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ি সরবরাহ হচ্ছে রাজধানী ঢাকার নামি-দামি ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোয়। শুধু ঢাকা নয়; চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য জেলা শহরেও যাচ্ছে তাদের কাজ করা পোশাক। আর এসব কারুশিল্পী হচ্ছেন গ্রামের গৃহিণী ও শিক্ষার্থীরা। যাঁরা গৃহস্থালির কাজের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের মাধ্যমে পরিবারের ও সমাজের অর্থনৈতিক অবলম্বন তৈরিতে অবদান রাখছেন।
মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সিল্ক, মসলিন ও আদিকর্টন পাঞ্জাবিসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের গলা ও হাতের কারুকাজ করা হচ্ছে। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন, নকশী ও আড়ং ব্র্যান্ডসহ ছোট বড় অন্তত ৪০টি ব্যান্ডের পাঞ্জাবির কারুকাজ করছেন অসচ্ছল পরিবারের এসব নারী শ্রমিক।
জানা যায়, ১৯৮৩ সালে মানিকগঞ্জে শুরু হয়েছিল পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ির গায়ে সুই-সুতা দিয়ে নকশা বুননের কাজ। শুরুতে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দুস্থ নারীদের এ কাজে প্রশিক্ষণ দেয় বেসরকরারি সংস্থা ব্র্যাক। নিজস্ব বিপণন কেন্দ্র আড়ংয়ের মাধ্যমে এসব পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করে সংস্থাটি। এরপর ব্যক্তিগত ও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শুরু হয় পাঞ্জাবির ভরাট কাজ। এভাবেই গত দুই দশকে এই নকশার কাজে ঘটে গেছে নীরব বিপ্লব। শুরুর দিকে কাজটিকে ছোট করে দেখা হলেও বর্তমান সময়ে সেই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পাল্টে গেছে। সময়ের সাথে সাথে অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী এই কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
এখানকার নকশাতোলা পাঞ্জাবি-ফতুয়া বিক্রি হয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। রফতানি হয় কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ বিভিন্ন দেশে। নামী-দামি শোরুমগুলোতে বাহারি রঙের নজর কাড়া হাতের কাজের পাঞ্জাবি-ফতুয়াগুলো সরবরাহ করা হয় মানিকগঞ্জ থেকে।
মানিকগঞ্জ শঙ্খনীল ফ্যাশন কারখানার নকশি কারিগর সালমা বেগম জানালেন, সারাবছর নকশা তোলার কাজ করলেও প্রতিবছর ঈদের আগে কাজের চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রোজা শুরু হওয়ার আগে থেকে দিন রাত পরিশ্রম করতে হয়। এই কারখানার আরেক নকশি কারিগর নাদিয়া জানান, তাদের হাতে তৈরি পোশাকের কদর তারা তেমন বুঝেন না। যখন মানুষজন এই পোশাকগুলো বড় বড় শোরুম থেকে কিনে ব্যবহার করেন তখনই তারা বুঝতে পারেন এগুলো তাদের হাতে তৈরি।
শঙ্খনীলের পরিচালক রজনী খান রুম্পা বলেন, ‘আমাদের এখানে গ্রামীণ নারীদের দিয়ে পাঞ্জাবি, শাড়ি, কামিজ ও ছোটদের বিভিন্ন ধরনের পোশাকে নকশির কাজ করা হয়ে থাকে। আমাদের এই পোশাকগুলো দেশাল ও মেঠোপথে পাঠানো হয়।’ সদর উপজেলার কেওয়ারজানি গ্রামের রোকেয়া আক্তার জানান, নকশার আকার অনুয়ায়ী একেকটি পাঞ্জাবিতে ভরাট কাজ করে পাওয়া যায় তিনশ’ থেকে হাজার টাকা। একেকটি পাঞ্জাবি নকশা করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। এসব ছাড়াও তারা শাড়ি, থ্রি পিস সেলাইও করে থাকেন। বাড়ির গৃহস্থালি কাজ শেষ করে সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য এ কাজটি করছেন তারা। একই গ্রামের কলেজছাত্রী নাছরিন আক্তার জানান, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি এই কাজ করে থাকেন। আগে এই কাজে সবাই আসতে চাইতো না। এখন দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ায় অনেক শিক্ষিত তরুণীরাও এই কাজ করছেন। প্রতিমাসে চাঁর থেকে পাঁচটি পাঞ্জাবির কারুকাজ করা সম্ভব হয়। এতে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ টাকা ব্যয় করা হয় ব্যক্তিগত কাজে।
ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের মির্জাপুর রাজবংশী পাড়ার সন্ধ্যা রাণী রাজবংশী জানান, তার স্বামী নেই। দুই সন্তান ও মা বাবা নিয়ে তার সংসার। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি তিনি পাঞ্জাবি সেলাইয়ের কাজ করেন। এটি করে তার সংসারে বাড়তি আয় হয়। বেওথা গ্রামের গৃহবধূ সবজান বিবি জানান, তিনি ১০ থেকে ১২ বছর ধরে সংসারের কাজের ফাঁকে এই কাজটি করছেন। প্রতিদিন তিন-চার ঘণ্টা কাজ করলে মাসে আয় হয় ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ঈদের আগে চাপ থাকে। সে জন্য ঈদের দুই মাস আগে ছয়-সাত ঘণ্টা কাজ করেন। তাতে আয়-রোজগারও বেড়ে যায়। তবে বান্দুটিয়া গ্রামের জাহানারা বেগম বললেন, মজুরি আরেকটু বাড়ালে তাঁদের সুবিধা হতো। কেননা তাঁদের হাতের কাজের একটি পাঞ্জাবি দোকানে যে দামে বিক্রি হয় সে তুলনায় তাঁদের মজুরি অনেক কম দেওয়া হয়। তাঁর হিসাবে একটা পাঞ্জাবিতে সুই-সুতার কাজ করে তাঁরা বড়জোর ৩/৪শ’ টাকা পান। অথচ একটি পাঞ্জবি কমপক্ষে বিক্রি হয় দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায়।
কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে আবার কয়েকজন মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় একত্র করে শুরু করেছেন এই হ্যান্ডিক্র্যাফটের ব্যবসা। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চলছে এই নকশার কাজ। কোথাও টিনের সিট তুলে আবার কোথাও নিজ ঘরে বসেই চলছে সুই সুতার এই নান্দনিক কাজ। অনেকেই সারাবছর এ কাজ না করলেও ঈদকে সামনে রেখে লেগে যান সুই সুতা হাতে। স্কুল-কলেজের ছাত্রী, গৃহবধুসহ অনেকেই হয়ে যান মৌসুমী কারিগর। এই সময়টি অনেকটা উৎসবে রূপ নেয় এই অঞ্চলে।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামি ব্র্যান্ডের শোরুমে বিক্রি হয় মানিকগঞ্জের নকশী করা পাঞ্জাবি। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে কে-ক্রাফট, অঞ্জনস, বাংলার মেলা, রং, আবর্তনা, আড়ং, অন্যমেলা, ওজি, বাংলার রং, তুলি, শেকড়, ড্রিম ফ্যাশন ওয়্যার, ডাইজেন, নোঙর, ঋতু বৈচিত্র্য, নান্দনিক, দেশ কারুপণ্য, খাদি ঘর, মনোরম , নিপূণ, কুমুদিনীসহ বিভিন্ন শোরুম ও বুটিক হাউজ।
জননী উইভিং অ্যান্ড ক্রাফটসের মালিক রফিকুল ইসলাম পরান জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর আগে এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। এবারের ঈদ ঘিরে ব্যাপক পরিমাণে পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এসব পোশাকে হাতের কাজ করার জন্য তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন অন্তত আট হাজার নারী। এবারের ঈদে তিনি অন্তত ৫০ হাজার পিস পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ি সরবরাহ করেছেন ঢাকার বিভিন্ন নামিদামি শোরুমে ।
ঘিওরের বানিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চতু জানায়, গ্রামীণ এসব নারী নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। যে কাপড় দিয়ে এসব পোশাক তৈরি হচ্ছে, তার অধিকাংশই আসছে সাটুরিয়ার বরাঈদ, হরিরামপুর, ঘিওর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার তাঁতিদের কাছ থেকে। এখানকার উৎপাদিত পাঞ্জাবি-ফতুয়া আর শাড়ি গুণে-মানে সেরা হওয়ার কারণে সারা দেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা।
নকশী নামের হ্যান্ডিক্রাফটস প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মানিকগঞ্জের তিন বন্ধু মাসুদ, মিল্টন ও সুমন। মানিকগঞ্জ শহরে তাদের এখন নকশী, নকশী প্লাস ও নকশী আনলিমিটেড নামে তিনটি বড় শোরুম রয়েছে। আট হাজার নারী নিয়মিত পাঞ্জাবি ভরাটের (নকশা বুনন) কাজ করেন তাদের প্রতিষ্ঠানে।
মানিকগঞ্জ আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন জানান, আয়েশা আবেদ সেন্টার থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এ সেন্টারে ছয় হাজার নারী শ্রমিক পাঞ্জাবি-ফতুয়া ও শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাকের নকশার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী কোয়ালিটি ঠিক রেখে এসব পোশাক তৈরি করা হয়। ভালো কোয়ালিটির কারণেই মানিকগঞ্জের নকশি করা পোশাকের চাহিদা বেশি। ঈদের সময় এসব পোশাকের কদর বেশি থাকে। এবার প্রায় ৮০ হাজার পোশাক মানিকগঞ্জ থেকে শুধুমাত্র আড়ংয়েই যাচ্ছে।
যাদের হাতের স্পর্শ আর ভালোবাসায় তৈরি পোশাকে অনেকের ঈদ হয়ে উঠবে প্রাণবন্তময় মানিকগঞ্জের মতো দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেই সব নকশী শিল্পীদের জীবনটাও সাজুক নান্দনিক সাজে এমন প্রত্যাশা সবার।