সমাজের নানান অসঙ্গতি দূরীকরণে কাজ করছে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা

সাংস্কৃতিক দলের যাত্রা শুরু
আমাদের সমাজে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের কোন ধরনের স্বার্থ ছাড়া অন্য ব্যক্তি বা সাজের সকল ধরনের অসংগতিগুলো দূর করে একটি সুন্দর সমাজ তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে যায়। বাংলা ইউনিয়নে কাশিপুর গ্রামের তেমনি উদ্যোগী ব্যক্তি মো: বাবুল মিয়া। বাবুল মিয়ার নেতৃত্বে ২০১৯ সালে বাংলা গ্রামে কিছু সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি, বাউল শিল্পী, নাট্য কমী, বাদ্য শিল্পী, উদ্যোগী যুব নিয়ে গড়ে উঠে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সংগঠনের লক্ষ উদ্দেশ্য
সমাজের সকল ধরনের অসংগতি দূরীকরণে জাত, ধর্ম,বর্ণ উচ,ু নিচু, নারী, পুরুষে ভেদাভেদ দূর করে একটি সুন্দর সমাজ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনটির পথ চলা শুরু হয়।

প্রবীণ অধিকার আদায়ে সাংস্কৃতিক প্রচারণা
সংগঠনের শুরুতে সদস্যরা নিজেদের আগ্রহে নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন গ্রামে যাত্রা পালা, বাউল গানের আসরে অংশ নিতেন। ২০১৯ সালে সংগঠিত হয়ে কার্যক্রম শুরু করে। সামাজিক সমস্যা সমাধানে সকলে দলীয়ভাবে কাজের সিদ্ধান্ত নেন। কাজ শুরু করেন অবহেলিত প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে। প্রবীণ অধিকার বিষয়ে সাংস্কৃতিক প্রচারণা কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে বারসিক। পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তির প্রতি অবহেলা, যৌথ পরিবার ভেঙে এক পরিবার সৃষ্টি, নবীন প্রবীণে সম্পর্কে অবনতি ইত্যাদি ছোট ছোট কারণে যখন পারিবারিক বন্ধনগুলো ভেঙে সমাজে অসঙ্গতি সৃষ্টি হয় তখন সমস্যা দূরীকরণে সমাজের প্রতিটি স্তরে জন সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ করা ও নবীন প্রবীণের সম্পর্কে উন্নয়নে দীর্ঘ তিন বছর কাজ করে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন। যাত্রা পালা, বাউল গানের আসর, পথ নাটক, গ্রাম সভা, ইত্যাদির পাশাপাশি স্কুল পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণার কাজ করে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ বান্ধব প্রচারণা
পরিবারের প্রবীণ ব্যক্তিদের যত্ন, তাদের জ্ঞান, তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরির লক্ষ্যে ক্লাস পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি পরিবেশ প্রাণবৈচিত্র সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে বাংলা ইউনিয়নে ২টি স্কুল কৃষ্ণ গবীন্দ্র উচচ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করছে সংগঠন। বিষয়ভিত্তিক প্রচারণা কাজে সার্বিকভাবে সহায়তা করে স্কুলে শিক্ষকগণ ও বারসিক। পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার ফলে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে গাছ কিনে নিজেদের বাড়িতে রোপণ করেন প্রতিবছর।

পরিবেশ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় বৃক্ষ রোপণ
সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমের আয়োজন করে সংগঠনের সদস্যরা। গত বছর সংগঠনের উদ্যোগে ৫০টি বাড়িতে ২টি করে ফলের গাছ রোপণ করা হয়। চলতি বছর পাশ্ববর্তী সহিল পুর গ্রামের জেলে পাড়ার পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণে ৩০টি জেলে পরিবারের মাঝে ফলজ গাছ বিতরণ করা হয়। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে কাজ করছে বারসিক।

শক্তিশালী হয়েছে পারিবারিক বন্ধন
শুধু সাংস্কৃতিক প্রচারণার উদ্দেশ্যে সংগঠনের যাত্রা শুরু করলেও সমমনা সংগঠনের প্রতিটি সদস্যদের মধ্যে গড়ে উঠেছে একটি সামাজিক বন্ধন। ৫টি গ্রামের সদস্য নিয়ে তৈরি সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ফলে নিজ গ্রাম ছাড়িয়ে অন্যান্য গ্রামের যে কোন ধরনের পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যায় ছুটে যায় সদস্যরা। পারিবারিক কলহ, দরিদ্র কিশোরীদের বিয়ে, এমনকি আশপাশে যে কোন গ্রামের বাল্য বিয়ের খবর পেলে ছুটে যায় সংগঠনের সদস্যরা। এ বিষয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে দলের সভা প্রধান বাবুল মিয়া।

প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ে সংগঠিত করা
বাংলা সহিলপুর গ্রামে জেলে পরিবারের কয়েকজন জেলে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্য। জেলে সদস্যদের মাধ্যমে জানতে পারেন বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনে উন্নয়নের নামে মানুষের বিভিন্ন কার্যক্রম যা নদী, বিল, পুুকুরের ইত্যাদি প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হচ্ছে। যার ফলে নদীতে মাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচেছ, যার প্রভাব পড়ছে অসহায় জেলে পরিবারগুলোর উপর। বছরের অধিকাংশ সময় মাছ থাকেনা স্থানীয় বিলে। সেই সাথে জেলেদের জন্য বরাদ্য কোন ধরনে সরকারী সুবিধা পায়না জেলে পরিবারগুলো। তাদের এ ধরনের নানামুখী সমস্যা সমাধানে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেয়। সংগঠনের উদ্যোগে প্রান্তিক জেলে পরিবারের ৩০ জন সদস্য নিয়ে বর্তমানে একটি জেলে সংগঠন তৈরি হয়েছে।

যুবদের সমাজিক কাজে যুক্ত করা
মোবাইল অপব্যবহার, অপসংস্কৃতির প্রভাবে ভেসে যাওয়া যুবদের সংগঠিত করে সমাজিক কাজে যুক্ত করা কাজ করছে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংগঠনের উদ্যোগে কাশিপুর গ্রামের ২০ জন্য যুব নিয়ে তৈরি হয়েছে যুব সংগঠন। সংগঠনের যুবরা নানা পেশার সাথে জড়িত। তারা দলীয়ভাবে প্রতি সপ্তাহে গ্রামে পালা করে নিজেদের বাড়ির উঠানে বাউল গানের আয়োজন করে। নিজেরা গান তৈরির পাশাপাশি নেত্রকোনা বিভিন্ন বাউলদের লেখা গানগুলো সংগ্রহ করে চর্চা করে থাকে, যা যুবদের সকল ধরনের অসামাজিক কাজ থেকে দূরে রেখে সুশীল সমাজ তৈরীতে আগ্রহ সৃষ্টি করে।

সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র
সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনায় সংগঠনের উদ্যোগে বাংলা বাজারে গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। সংগঠনের সকল কার্যক্রম কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকে। সাংস্কৃতিক প্রচারণার পাশাপাশি গ্রামের সকল ধরনের বিচার সালিশ কেন্দ্রের মাধ্যমে করে থাকে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।


প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম
সংগঠনের উদ্যোগে স্থানীয় মানুষের সেবা প্রতিষ্ঠানের সাথে সুসম্পর্ক তৈরিতে কাজ করছে সংগঠন। বাউল, জেলে, প্রবীণ, বিধবা ব্যক্তিদের ভাতা প্রাপ্তিতে সংগঠনের উদ্যোগে নিয়মিত ইউনিয়ন পরিষদ, সমাজ সেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগের কাজে সহায়তা করে সংগঠন। ইউনিয়ন পরিষদ দুরে থাকায় দরিদ্র পরিবারের মাঝে ন্যায্য মূল্যে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম ইউনিয়ন পরিষদ সংগঠনের সহায়তায় কেন্দ্রের মাধ্যমে করে থাকে। তাছাড়া চলতি বছর প্রায় অর্ধ শতাধিক দরিদ্র ব্যক্তির মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে সংগঠনের সদস্যরা।

রক্তদানে সহায়তা
গ্রামের যে কোন ব্যক্তির রক্তের সহায়তার প্রয়োজন হলে সংগঠনের সদস্যরা স্বেচ্ছায় রক্ত দিয়ে থাকে সংগঠনের সদস্যরা। এমনকি নিজ খরচে নেত্রকোনা জেলা সদর ও ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে যান গ্রামের দরিদ্র রোগীদের।

শতবর্ষী গাছ রক্ষায় প্রচারণা
পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা শতবর্ষী গাছ রক্ষায় কাজ করছে সংগঠন। বাংলা ইউনিয়নে সকল ধরনের শতবর্ষী গাছ রক্ষায় সাংস্কৃতিক প্রচারণার পাশাপাশি প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণে কাজ করছে আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন।

নিজস্ব চিন্তা চেতনায় সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে কিছু সংস্কৃতিমনা ব্যক্তির উদ্যোগে গঠিত আদি সাংস্কৃতিক সংগঠন যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ক্রমেই তা বিস্তার বেড়েছে। সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমে সমাজের অসংগতি দূর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সংগঠনের সদস্যরা। সংগঠনের কার্যক্রম গতিশীল করার জন্য প্রয়োজন বিত্তশালী ব্যক্তিদের সহায়তা ও সমমনা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা।

happy wheels 2

Comments