বাল্য বিয়ে একটি অভিশাপ
মানিকগঞ্জ থেকে রিনা আক্তার
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বাল্য বিয়ে। বাংলাদেশে ছেলেমেয়ের বিয়ের বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবে: ছেলে ২১ বছর এবং মেয়ে ১৮ বছর। এই বয়সের নিচে বিয়ে দেওয়া হলেই সেটি বাল্যবিবাহ বলে অভিহিত হবে। এদেশের প্রায় ৬৪% মেয়েদের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় । তাদের জীবনে আর ফুল হয়ে ফোটা হয় না, কুড়িতেই ঝড়ে যায় তাদের জীবন। এমনই একটি মেয়ে রিতু আক্তার (১৭)।
মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার রায়দক্ষিণ গ্রামের বাসিন্দা রিতু আক্তার। তার বাবার নাম বাচ্চু মিয়া (৫৫)। তিনি একজন কৃষক, মায়ের নাম পারুল আক্তার (৪০), তিনি একজন গৃহিনী। তারা চার ভাইবোন, তার বড় ভাই ৯ বছর বয়সে মারা যায়।
ভাইবোনদের মধ্যে সে ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে, ভাই অটো গ্যারেজে কাজ করে।
রিতু আক্তার যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে তখন তার বাবা ধল্লা গ্রামের ব্যবসায়ী বাচ্চু মিয়ার ছেলে সাকিব হোসেনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেন। একথা শোনার পর তার মার আর বাবার কাছে অনেক আকুতি মিনতি করে। তার মা একটু অমত থাকলেও তার বাবার কথায় তিনি রাজি হয়ে যান। তাঁর অমত থাকা সত্ত্বেও তাঁর বাবা তাকে বিয়ে দেন।
যে বয়সে একটি মেয়ের হেসে খেলে বেড়ানোর সময় তখন তাকে ঠেলে দেওয়া হলো সংসার সামলাতে। কৈশোর হলো একটি ছেলে মেয়ের শারীরিক ও মানসিক গঠনের সময়। এই সময়ে যদি একটি মেয়েকে বিয়ে দেওযা হয় তাহলে সে কি থেকে কি করবে? সে তো নিজেকেই সামলেতে পারেনা অপরদিকে সংসার স্বামী, শ্বশুর-শ্বাশুরি, তার মধ্যে যদি কিশোরী মা হয় তাহলে তো আর কথায় নেই!
কিশোরী রিতুর বিয়ে হওয়ার পর তাকে শুনতে হয় নানান কথা। যেখানে মা রেখেছিল তাকে পরম যত্নে এখানে তাকে সামলাতে হয় পুরো পরিবারকে। কাজে একটু ভুল হলেই তাকে শুনতে হয় অনেক কথা। বিয়ের দেড় মাস পরে সে জানতে পারে তার স্বামীর আসল পরিচয়। তার স্বামী একজন মাদকাসক্ত, সারাদিন কোন কাজই করে না এবং রাতে প্রায় সময়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। শ্বশুর-শ্বাশুরি এইসব কথা বলাতে তারা কিছুই বলে না। তার স্বামীকে যখন সে এই নেশা ছাড়তে বলে তখনই তার উপর শুরু হয় অমানবিক নিযার্তন, তাকে তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনার কথাও বলে। এইসব চলতে থাকলে এক সময় সে বাবার বাড়িতে চলে আসে এবং বাবা-মাকে সব খুলে বলে। কিছুদিন যাওয়ার পর তার স্বামী তাকে নেওয়ার জন্য আসে, সবাই ভাবে হয়তোবা সে ভালো হয়ে গেছে। সে শ^শুর বাড়িতে চলে যায়, কিন্তু যাওয়ার পর কয়েকদিন না যেতেই সে তার স্বামীর নেশাগ্রস্ত চেহারা দেখতে পায় । শুরু হয় আবার সেই অমানবিক নিযার্তন। তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ায় তার বাবার সাথে তার নিজ বাড়িতে চলে আসে। বিয়ের আটমাস পরেই তাদের ডির্ভোস হয়ে যায় ।
ডিভোর্স হওয়ার পর সে তার নানাবাড়ি চর আজিমপুর আবাসনে চলে আসে। সেখানে বেসরকারি বারসিক’র বিভিন্ন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জানতে পারে বাল্য বিয়ের কুফল, বয়োঃসন্ধিকালীন সমস্যা- স্বাস্থ্যের পরিচর্যা, নারীর প্রতি বিভিন্ন সহিংসতার কথা শুনে এবং নিজ আগ্রহে বারসিক’র কর্মীদের সাথে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কথাগুলো বলে। রিতু বলে, ‘আপনারা যেহেতু নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন, আমি চাই আপনারা আমার এ করুণ পরিণতি সকলের কাছে তুলে ধরেন, যাতে আর কেউ আমার মত বাল্য বিবাহের শিকার না হয়। এভাবে যেন আর কারও কৈশোর জীবন অকালে নষ্ট না হয়।’