মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করি
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে আলপনা নাফাক
ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি হয়েও আজ তিনি পরিবারের হাল ধরছেন। নাম মো. সুমন মিয়া। খারনৈ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। বাবা-মায়ের পাঁচজন সন্তানের মধ্যে তিনি ৪র্থ। সুমনের পরিবারে ২ বোন ও তিন ভাই রয়েছে। দু’ভাই এবং এক বোনের বিয়ে হয়েছে। ভাইয়েদের আলাদা সংসার। এখন পরিবারে এক বোন, মা, বাবা আর সুমন। সুমনের ছোট বোন নবম শ্রেণীতে পড়ে। সুমন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। খুব ছোট বেলায় তার নাকি প্রচুর জ্ব¡র হয়েছিল। ২ বছর বয়সে ধরা পড়ে সুমন একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তখন থেকে সুমনের চিকিৎসা শুরু হয় গ্রামে। তারপর ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়েছে কিন্ত সুমনকে আর ভালো করা যায়নি। সুমনের বয়স এখন ২৩ বছর। তিনি কলমাকান্দা সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএসএস ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাঁর স্কুল জীবন শুরু। বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে স্কুলের অবস্থান। প্রতিদিন তার মা অথবা বাবা তাকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন। আবার স্কুল ছুটি হওয়ার সময় তাকে নিয়ে আসতেন।
এই প্রসঙ্গে সুমনের মা মাজরিনা খাতুন বলেন, ‘সুমনের লেখাপড়ার দিকে আগ্রহ ছিল। তাই আমাদের কষ্ট হলেও তাকে স্কুলে দিয়ে আসতাম। আমাদের পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো নয়; যার কারণে তাকে আমরা হুইল চেয়ার কিনে দিতে পারি নাই। এভাবেই কোলে করে স্কুলে দিয়ে আসতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুমন যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ে তখন ওর্য়াল্ড ভিশন বাংলাদেশ থেকে একটি হুইল চেয়ার পায়। তখন থেকে সে হুইল চেয়ারে করে স্কুলে যাওয়া-আসা করত।’ সুমন মিয়া প্রাইমারি স্কুল পাশ করার পর গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে এবং এসএসসি পাশ করেন। এসএসসি পাশ করার পর তিনি কলেজে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবে তিনি নিজের পড়া চালিয়ে যান।
সুমন মিয়া ২০১৫ সাল থেকে নিজের বাড়িতে ৫ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এখন তার প্রাইভেট পড়ানোর চাহিদা অনেক বেড়েছে। সেই ৫ জন থেকে এথন সে ৮৮ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। সকালে তিন ব্যাচ এবং বিকালে তিন ব্যাচ করে পড়ান। ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। শুধুমাত্র গণিত পড়ান তিনি। অনেক সময় ইংলিশ ও অন্যান্য বিষয়গুলোও দেখিয়ে দেন।এই প্রসঙ্গে সুমন মিয়া বলেন, ‘আমি যেহেতু স্বাভাবিক মানুষ না। ইচ্ছে করলেই আমি বড় ধরনের কাজ করতে পারব না। তাই আমি এই প্রাইভেট পড়ানো পেশাটা মাথায় রাখি। আর সেই থেকে আমি কাজটা শুরু করি। আমি যে সব শিক্ষার্থীকে পড়াই তাদের মধ্যে যারা খুব গরিব তারা খুব কাছ থেকে ফিস নেই না।’
সুমন মিয়া সম্পর্কে তাঁর ছাত্রী আসমা বেগম বলে, ‘সুমন স্যার আমাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন। একবার যদি না পারি তখন স্যার আবার আমাদের সুন্দর করে বুঝান। তাই আমরা সুমন স্যারের কাছে পড়ি। সুমন স্যার অন্যান্য স্যারদের থেকে ফিস কম নেন।’ সুমনকে নিয়ে তাঁর বড় বোন সেলিনা বেগম বলেন, ‘সুমনকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। কারণ সে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও যে কাজ করছে একজন স্বাভাবিক মানুষ সে কাজ করে ন! সুমন নিজে পড়াশুনা করে এবং ছোট বোনকে পড়ায়। আবার সংসারও চালায়। প্রাইভেট পড়ানোর টাকা দিয়ে সে পরিবারের হাল ধরছে।’
নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে সুমন বলেন, ‘আমার ভবিষৎ পরিকল্পনা হল একটি সরকারি চাকুরি করার। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষায় আছি। রেজাল্ট হলেই চেষ্টা করব একটা চাকুরির জন্য। তা না হলে আমার এই কাজটায় চালিয়ে যাব আজীবন। আমার এই সমস্যার জন্য লোকদের কাছ থেকে অনেক ধরনের কথা শুনতে হয়েছে এখনও শুনছি। কিন্ত আমি লোকদের কথায় কিছু মনে করি না। মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করি। তবে মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়। কারণ আমিও তো মানুষ।’